মায়ার টানেই করিম উৎসবে আসেন বাউল এমরান
‘তোমার কি লাগে না মায়া আমার দুঃখ দেখিয়া, বন্ধুয়ারে আমি যত দোষী তোমার লাগিয়া...।’ ১৯৭২ সালের কথা। বাউল এমরান শাহর বয়স তখন আট। বাড়িতে একটি রেডিও ছিল। একদিন সকালে রেডিওতে এই গান বেজে ওঠে। গানের মায়া তাঁকে আকুল করে। মনে দোলা দেয়। উতলা করে। রেডিওতে গান শুনে শুনে মুখস্থ করেন এমরান। সেই থেকে গান গাওয়া, বাউলিয়ানার শুরু তাঁর। এখন বয়স ৬২ বছর। এখনো গানেই আছেন। গান লেখেন, গান করেন। গান নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান।
সুনামগঞ্জে চলছে দুই দিনব্যাপী বাউল শাহ আবদুল করিম লোক উৎসব। গতকাল শুক্রবার থেকে জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে বসেছে শাহ আবদুল করিমের ভক্ত-অনুরাগীদের মিলনমেলা। এই উজানধল গ্রামেরই জন্মেছেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। সেখানেই বাউল এমরান শাহর সঙ্গে কথা হয় গতকাল পড়ন্ত বিকেলে। করিমের বাড়ির দক্ষিণ পাশে কালনী নদীর তীরে অন্যদের সঙ্গে গানের মজমায় ছিলেন তিনি।
এমরান শাহর বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামে। বাবা কালা মিয়াও ছিলেন সংগীতপ্রেমী। প্রতিবছর করিম উৎসবে আসেন এমরান। এবার তাঁর সঙ্গে এসেছেন কুষ্টিয়ার আরেক বাউলশিল্পী মৌলি বিশ্বাস। তিনিও বাউল করিমের ভীষণ ভক্ত। দুজনে মিলে বাউল করিমের প্রিয় নদী কালনীর পাড় ধরে হাঁটছিলেন। কথায় কথায় এমরান শাহ আবদুল করিম ও তাঁর গানের সঙ্গে পরিচয়, উজানধলে আসা, শিষ্যত্ব গ্রহণসহ নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। শাহ আবদুল করিমের সহধর্মিণী সরলা বেগমকে তিনি ‘মা’ ডাকতেন। করিম নাকি তাঁকে দেখিয়ে বলতেন, ‘এ আমার আরেক পুয়া (ছেলে)।’
এমরান শাহ বলেন, ছোট্টবেলায় সেই গান শুনে মা অমৃতা বেগমের কাছে এই গান কার লেখা জানতে চেয়েছিলেন। তখনই অমৃতা বলেছিলেন, এটি শাহ আবদুল করিমের লেখা। সেই থেকে করিমের প্রতি তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধার শুরু। মা জানিয়েছিলেন, করিম তাঁর (মা) বাবার বাড়ি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে নিয়মিত যাতায়াত করেন। এর আট বছর পর একদিন এমরান খবর পান, করিম তাঁর মামার বাড়ি গেছেন। এমরান ছুটে যান সেখানে। ঘরে ঢুকে একজন দীর্ঘদেহী লোককে বসা দেখেন। কোনো কথা না বলেই ভক্তি দেন। করিম তখন বলেন, ‘তুমি কেটা বা, আমার কাছে কিতা চাও?’ এমরান তখন করিমের মতো গান নিয়ে থাকার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন।
সেদিনের স্মৃতি মনে করে এমরান বলতে থাকেন, শাহ আবদুল করিম তাঁকে বলেছিলেন, ‘বড় অইতে অইলে হিংসা-নিন্দা করা যাইত না, বাবা। মন থাকি লোভ বাদ দিত অইব।’ সেই কথা অন্তরে রেখেই চলেন বাউল এমরান। ৪৫ বছর বয়স থেকে উজানধলে করিমের আস্তানায় আসেন। সন্তানের মতো আদর–স্নেহ পেয়েছেন করিমের কাছ থেকে। বাউল করিমের একমাত্র ছেলে বাউল নূর জালালও তাঁকে ভাইয়ের মতো দেখেন। উজানধলে আসার শুরুর দিকের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাউল করিমের ঘরে খুব অভাব ছিল। এমন অভাব খুব কমই দেখেছি। দুপুরে সামান্য খেলে রাতের ব্যবস্থা নেই। ভক্ত-শিষ্যরা যা নিয়ে আসতেন, সবাইকে নিয়েই তিনি তা খেতেন। বলতেন, রাইতের চিন্তা কইরো না, মওলায় একটা ব্যবস্থা করবানে...।’ করিম অন্য রকম মানুষ ছিলেন। হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। ভক্তদের বড় বেশি ভালোবাসতেন। এই মায়ার টানেই ভক্তরা উজানধলে আসেন বারবার।