পাবনায় আশ্রয়ণ প্রকল্প
ঘরগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ায় আবারও আশ্রয়হীন
সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে একে একে পরিবারগুলো আশ্রয়ণের ঘর ছাড়তে থাকে। টিনের চালা খুলে নিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেয়াল।
কোনো কোনো ঘরের দেয়াল আছে কিন্তু চালা নেই। কোনোটার দেয়ালও নেই, মেঝেতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ইটপাটকেল। কেটে নেওয়া হয়েছে ঘরের আশপাশের গাছ। পুরো এলাকা দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো গ্রাম।
পাবনা জেলা সদরের ভাঁড়ারা ইউনিয়নের পশ্চিম জামুয়া গ্রামে অসহায় গৃহহীনদের জন্য নির্মাণ করা একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বর্তমান চিত্র এটি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হুমকি দিয়ে বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর সন্ত্রাসীরা ঘরগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বর্তমানে প্রকল্পের জমির মালিকানা দাবি করে সেখানে ব্যক্তিমালিকানার সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রকল্পে থাকা অসহায় গৃহহীন পরিবারগুলো আবার ঘরছাড়া হয়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ২০২১ সালে গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পটি তৈরির উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সরকার। জেলা সদরের ভাঁড়ারা ইউনিয়নে ভাঁড়ারা মৌজার ২৪৩ নম্বর দাগে ১ দশমিক ৩৮ একর জমি নিয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রকল্প এলাকায় তৈরি করা হয় ইটের দেয়াল ও টিনের ছাউনি দেওয়া ৬০টি ঘর। পরবর্তী সময়ে ঘরগুলো ইউনিয়নের অসহায় ও গৃহহীন ৬০টি পরিবারকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তখন থেকে পরিবারগুলো ওই সব ঘরে বসবাস করছিল।
স্থানীয় লোকজন ও ঘরের বাসিন্দারা বলছেন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট থেকে প্রকল্প এলাকায় তাণ্ডব শুরু হয়। সকাল-বিকেল সন্ত্রাসীরা এসে প্রকল্পে থাকা পরিবারগুলো অস্ত্রের মুখে ঘর ছাড়তে হুমকি দিতে থাকে। প্রাণভয়ে একে একে পরিবারগুলো ঘর ছাড়তে থাকে। গত কয়েক মাসে একদিকে একে একে পরিবারগুলো ঘর ছাড়তে থাকে, অন্যদিকে ঘরগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা পুরো প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট থেকে প্রকল্প এলাকায় তাণ্ডব শুরু হয়। সকাল-বিকেল সন্ত্রাসীরা এসে প্রকল্পে থাকা পরিবারগুলো অস্ত্রের মুখে ঘর ছাড়তে হুমকি দিতে থাকে। প্রাণভয়ে একে একে পরিবারগুলো ঘর ছাড়তে থাকে।
২১ জানুয়ারি সকালে সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের এক কোনায় ফসলি জমির পাশে গড়ে তোলা হয়েছিল আশ্রয়ণ প্রকল্পটি। তবে এখানে আর কোনো ঘরের অস্তিত্ব নেই। টিনের চালগুলো চুরি হয়ে গেছে। কেটে নেওয়া হয়েছে প্রকল্প এলাকায় বেড়ে ওঠা বিভিন্ন গাছ। খুলে নেওয়া হয়েছে দেয়ালের ইট। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ভাঙাচোরা ইটপাটকেল।
প্রকল্প এলাকার প্রবেশমুখে সাঁটানো হয়েছে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা রয়েছে, ‘নিম্নবর্ণিত সম্পত্তি লইয়া পাবনা সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা চলমান আছে। মামলার বাদী আকরাম প্রামানিক, আক্কাস প্রামানিক, ইসমাইল প্রামানিক, নবাব আলী, উম্বর প্রামানিক, ইব্রাহীম প্রামানিক ও নায়েব আলী প্রামানিক।’ তাঁদের পিতার নাম মরহুম আবুল হোসেন। বাড়ি ইউনিয়নের পশ্চিম জামুয়া গ্রামে।
যোগাযোগ করা হলে সাইনবোর্ডে নাম থাকা নায়েব আলী প্রামানিক এবং আক্কাস প্রামানিকের ছেলে আতিক প্রামানিক জমিটি নিয়ে মামলার কাগজপত্র দেখিয়ে বলেন, জমিটি তাঁদের পৈতৃক। ফলে আশ্রয়ণ প্রকল্প করার সময় তাঁরা আদালতে মামলা করেছেন। মামলাটি চলমান থাকায় সাইনবোর্ডটি টাঙানো হয়েছে। তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকা বাসিন্দাদের ঘরছাড়া করতে তাঁরা বাধ্য করেননি। কাউকে ভয়ভীতিও দেখাননি। প্রকল্পের বাসিন্দারা নিজেরাই ঘর ভেঙে রেখে চলে গেছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রকল্পের জমিটি নিয়ে মামলা চলছে, এটা তাঁরা শুনেছেন। এরই মধ্যে ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তৎকালীন চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খাসজমি হিসেবে প্রকল্পের জমিটি নির্ধারণ করেন। পরে সেখানে ৬০টি ঘর তৈরি করে ৬০টি গৃহহীন পরিবারের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৫ আগস্টের পর আবু সাঈদ এলাকাছাড়া হয়েছেন। এর পর থেকেই প্রকল্প এলাকায় তাণ্ডব শুরু হয়েছে।
প্রকল্প ছেড়ে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া ফুলমতি বেগম নামের এক নারী বলেন, তাঁদের জমিজমা, ঘরবাড়ি কিছুই নেই। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরটি তাঁদের আশ্রয়স্থল ছিল। রাতারাতি একদল লোক এসে অস্ত্র ঠেকিয়ে তাঁদের ঘর ছাড়তে বলে। এরপর তাঁরা ঘর ছেড়ে বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
ফাতেমা খাতুন নামের অপর এক নারী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, আমাগের কিছুই নাই। ঘরডা কুনুমত মাথা গুঁজার ঠাঁই হইছিল। তাউ থাকলো না। এহন আমরা পতে পতে ঘুরতেছি।’
তদন্ত শেষে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য যা করণীয়, তা করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।মফিজুল ইসলাম, পাবনার জেলা প্রশাসক
জানতে চাইলে ভাঁড়ারা ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ খান বলেন, প্রকল্পে থাকা পরিবারগুলোর ওপর অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাঁদের রাতারাতি ঘরছাড়া করা হয়েছে। বিষয়টি তাৎক্ষণিক স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। গৃহহারা মানুষগুলো অনেক কষ্টে আছেন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন পদক্ষেপ নিলেই এর একটা সুরাহা হবে বলে তিনি আশা করছেন।
এ প্রসঙ্গে পাবনার জেলা প্রশাসক মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি জানার পর ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। কারা কেন ঘরগুলো ভেঙেছে, সে বিষয়ে তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য যা করণীয়, তা করা হবে। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।