শিক্ষার্থী-স্থানীয়দের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ভাঙচুরের তিন কারণ

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রোববার সন্ধ্যায় চানগাঁও এলাকাবাসীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ সময় ভাঙচুর করা হয় অনেকগুলো দোকান।সোমবার সাভারের আশুলিয়ার বিরুলিয়ায়
ছবি: প্রথম আলো

সাভারের আশুলিয়ার বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যাম্পাস-সংলগ্ন চানগাঁওবাসীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ভাঙচুরের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ জানা গেছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও চানগাঁও এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তিনটি কারণ জানা গেছে।

কারণগুলো হলো চানগাঁও এলাকার কয়েকটি দোকান কয়েক দফায় বন্ধ করে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে কয়েকটি বাস্তবায়নের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অসন্তুষ্টি এবং শিক্ষার্থীরা চানগাঁও এলাকায় হামলা চালিয়েছে মাইকে, এমন ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীর উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববারের ঘটনার সূত্রপাত মূলত ২৭ অক্টোবর কয়েকজন যুবকের মারধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম ওরফে অন্তরের (২২) আহত হওয়ার পর থেকে। ২ নভেম্বর অন্তর মারা গেলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাত্রা বাড়ে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থী হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার, তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি, প্রক্টরের পদত্যাগ, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিহত শিক্ষার্থীর নামে স্থায়ী কিছু করার দাবি জানান।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে প্রক্টর পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা সব সময়ই নিশ্চিত করা হয়েছে এবং নিহত শিক্ষার্থীর নামে স্থায়ী কিছু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেয় প্রশাসন। রোববার সন্ধ্যায় প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীরা সামগ্রিক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করার অনুমতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালকের অপসারণের নতুন দুটি দাবি জানান।

শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বেশ কয়েকটি দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হয়েছিলেন। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু দাবির বিষয়ে কোনো কিছু না বলায় শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট হন। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে স্থানীয় ব্যক্তিদের হামলার খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা সেদিকে চলে যান। এলাকাবাসীর হামলায় ৮-১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন চানগাঁও সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে ৭০-৮০টি দোকান। এসব দোকানের মধ্যে ৫৫-৬০টি দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। অধিকাংশ দোকানের শাটার ভাঙা ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি দোকানের ভেতরের মালামাল ভাঙচুর করা হয়েছে।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর দুই-তিন দিন ধরে বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাস-সংলগ্ন চানগাঁও এলাকার দোকানগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। দোকানমালিকেরা দোকান বন্ধও রাখেন। রোববার বিকেলে দোকান বন্ধ রাখতে বলেন শিক্ষার্থীরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিকেল চারটার দিকে শিক্ষার্থীরা এসে সব দোকান বন্ধ করে দেন। স্থানীয় মানুষ সবাই শিক্ষার্থীদের বোঝাতে চান, তাঁদের সহপাঠীকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে আকরান গ্রামে। তাই এখানকার দোকানগুলো যেন খুলে দেওয়া হয়। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিতে শুরু করেন। কয়েকটি চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চ ভেঙে সড়কে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী কয়েকটি দোকানের শাটারে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এতে উচ্চ আওয়াজ হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ক্যাম্পাসে পাঠিয়ে দেন।

এরপর শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে পুনরায় একই স্থানে এসে এলাকাবাসীদের পাল্টা ধাওয়া দিয়ে পিছু হটিয়ে দেন। এ সময় এলাকাবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে আবার শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়। এলাকাবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি ভবনের জানালার কাচ ভাঙচুর করেন। শিক্ষার্থীরা আবার এলাকাবাসীদের ধাওয়া দিলে স্থানীয় মসজিদের মাইকে শিক্ষার্থীরা এলাকাবাসীর ওপর হামলা চালিয়েছেন জানিয়ে প্রতিরোধের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এতে এলাকাবাসী জড়ো হন। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

চানগাঁও বাজারের কয়েকটি দোকানের মালিক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘স্টুডেন্টরা আইসা প্রথমেই আমার দোকানগুলা আক্রমণ করছে। এরপর সব দোকানে আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টা ভাঙচুর করল। কেউ তাদের থামাইতে পারে না। লাস্টে মসজিদের মাইকে মাইকিং করা হলো। স্যারেরা ওদের দাবি মানে নাই, না মানলে আমরা কী করব। আমাদের দোকান ভাঙল, চেয়ার-টেবিলে আগুন ধরাইল।’

ছাত্ররা ৭০টি দোকান ভাঙচুর করেছেন বলে দাবি করেন চানগাঁও মোল্লা মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহরিয়ার সুমন। প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়েছে। সর্বমোট ১ কোটি ৮১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিষয়ে আন্তরিক হলে ব্যবসায়ীরাও তাদের পাশে থাকবেন।

রোববারের ঘটনায় কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছিলেন। এর মধ্যে একজনকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বাকিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসা প্রশাসন সহকারী অধ্যাপক এজাজ উর রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এদিকে চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সোমবার থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন ও স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার ও আন্তরিক করতে কমিউনিটি রিলেশনস এবং কমিউনিটি রিগ্রেশনস নামে সেল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব তথ্য নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে হল ছেড়ে চলে গেছেন। বাকিরাও যাচ্ছেন।