কক্সবাজারে বাঁকখালীর তীর থেকে ৪ দিনেও সরেনি ধ্বংসাবশেষ
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট অংশে যৌথ অভিযান চালিয়ে পাকা ও আধা পাকা ঘরবাড়িসহ চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। এতে দখলমুক্ত হয়েছে প্রায় ৩০০ একরের মতো বিরান ভূমি। পাঁচ মাস আগেও সেখানে প্যারাবন ছিল। তবে এই উচ্ছেদ অভিযানের পর ওই এলাকা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া মালামাল যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। কিন্তু কেউ সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছেন না।
গতকাল শনিবার বিকেলে নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, উচ্ছেদ অভিযানের সময় এক্সকাভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া ঘরবাড়ির ইট-পাথর, টিন, সীমানাদেয়াল, খুঁটিসহ নানা অবকাঠামো পড়ে আছে যত্রতত্র। কয়েকজন লোক এসব মালামাল পাহারা দিচ্ছেন, কিন্তু কেউ সরিয়ে নিচ্ছেন না।
এর আগে দখলদারের থাবায় প্যারাবন উজাড়ের পাশাপাশি বাঁকখালী নদীর দুই তীরের কয়েক শ একর জমি দখল করে তৈরি হয়েছে এক হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা। এ অবস্থায় দখলদারের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ একাধিক মামলা করে। বনাঞ্চল উজাড় বন্ধ, নদীর গতিপথ ধরে রাখা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার দাবিতে পরিবেশবাদী একাধিক সংগঠন উচ্চ আদালতে মামলা করে। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কার্যকর করতে মাঠে নামে জেলা প্রশাসন।
আবুল হোসেন (৪৫) নামের এক ব্যক্তি বলেন, ১ মার্চের অভিযানে তাঁর বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তখন ঘরের আসবাবসহ অন্য মালামাল ঘরের বাইরে রাখা হয়েছিল। এখন মালামাল সরানোর মতো জায়গা নেই। মালামালগুলো বিক্রির লোকজনও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই খোলা আকাশের নিচে সব মালামাল স্তূপ করে রেখেছেন তিনি।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বিপুল পরিমাণে প্লাস্টিক পণ্য ও পলিথিন রয়েছে। এসব ময়লা-আবর্জনা নদীর পানিতে মিশে বঙ্গোপসাগরে ভেসে যেতে পারে। এ ছাড়া ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা প্লাস্টিক মাটিচাপা পড়লে গাছপালা ধ্বংসের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ধ্বংসাবশেষ সরানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের পর যেসব মালামাল (ধ্বংসস্তূপ) মাঠে পড়ে আছে, তা সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ৮ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মালামাল সরানো না হলে এসব মালামাল বাজেয়াপ্ত দেখিয়ে নিলামে বিক্রি করে টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে। এ ছাড়া দখলমুক্ত করা ৩০০ একর জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
প্রতারণার শিকার ২০০ পরিবার
এর আগে দখলদারেরা ভুয়া কাগজ দেখিয়ে কিংবা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে প্যারাবনের প্রায় ২৫০ একর জমি অন্তত ৫০০ জনকে বুঝিয়ে দিয়ে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এখন সেখানে জেলা প্রশাসনের উদ্ধার অভিযানের পর ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রতারণার শিকার অন্তত ২০০ জন দরিদ্র মানুষ পথে বসেছেন।
কস্তুরাঘাট এলাকার প্যারাবনের পাশে তিন মাস আগে প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে টিনশেডের ঘর তৈরি করেছিলেন মহেশখালীর কুলসুমা বেগম (৫২)। ১ মার্চের উচ্ছেদ অভিযানে তাঁর ঘরটি ভেঙে ফেলা হয়। ঘরের আসবাব, মালামাল সরানো হলেও ভাঙা ইট, ঘরের দরজা জানালা, টিন, প্লাস্টিক সামগ্রী খোলা মাঠে পড়ে আছে। কুলসুমা বলেন, ঘর ভাঙা হবে এই কথা তাঁদের আগে জানানো হয়নি। এখন ধ্বংসস্তূপের মালামাল সরানোর মতো টাকাও নেই তাঁর কাছে। এখন এসব মালামাল বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তাঁর কাছে।
কুতুবদিয়ার গৃহবধূ সালমা আকতার (৪৪) প্যারাবনের তিন শতক জমি কিনে সেখানে দুই মাস আগে টিনের বাড়ি তৈরি করেন। এক পাশে তিনি নিজে থাকতেন। বাড়ির অন্য পাশ দুটি পরিবারের কাছে ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। তবে উচ্ছেদ অভিযানে বাড়ি ভেঙে ফেলায় তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সালমা বলেন, গ্রামের জায়গা জমি বিক্রি করে তিনি নদীর তীরে ওই জমি কিনেছিলেন। কেনার সময় তাঁকে বলা হয়েছিল, এসব ব্যক্তিমালিকানাধীন খতিয়ানি জমি। কিন্তু উচ্ছেদের পর জানতে পারলেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়ে খাস জমি কিনেছেন। এখন টাকা ফেরতের জন্য জমি বিক্রেতাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ। মাথা গোঁজার ঠাঁইও হচ্ছে না কোথাও।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, অবৈধভাবে প্যারাবনের জমি বিক্রি করে প্রায় ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন শহরের বদরমোকাম, কস্তুরাঘাট, পেশকারপাড়াভিত্তিক পাঁচটি সিন্ডিকেটের শতাধিক ব্যক্তি। ক্রেতাদের ভুয়া কাগজ দেখিয়ে অথবা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে প্যারাবনের প্রতি শতক জমি এক থেকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ ৩০০ একরের প্যারাবন নিধনের বিপরীতে (এক লাখ গাছ, পাখির আবাসস্থল, জীববৈচিত্র্যসহ) ৩০০ কোটির বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।