৯ বছর ধরে অনাবাদি শতাধিক একর জমি

যশোর ও নড়াইল জেলার সীমান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া কাঠুরিয়া খালটি এখন কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ঠাসা। পানিনিষ্কাশিত হয় না। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার হাতিয়াড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

কাঠুরিয়া বিলের বুক চিরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে কাঠুরিয়া খাল। যশোর ও নড়াইল জেলার সীমান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটির দক্ষিণ-পূর্ব পাশে নির্মাণ করা হয়েছে সড়কসেতু। সেতুটি নির্মাণ করার সময় খালে দেওয়া হয়েছিল আড়াআড়ি মাটির বাঁধ। নির্মাণকাজ শেষ করার পরও মাটির বাঁধটি অপসারণ করেননি ঠিকাদার। এতে বন্ধ হয়ে যায় পানিনিষ্কাশন। এতে জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে ‘বোরো ধানের ভান্ডার’ নামে পরিচিত কাঠুরিয়া বিলটি। প্রায় ৯ বছর ধরে বিলের প্রায় এক হাজার বিঘা জমিতে কোনো ধান চাষ হচ্ছে না।

কৃষকদের দাবির মুখে খালটির ১ কিলোমিটার ৬০০ মিটার খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তবে খালের মাটির বাঁধটি এ অংশে পড়ছে না। ওই অংশ খননের উদ্যোগ না নেওয়ায় খাল খননের সুফল নিয়ে আশঙ্কা করছেন ভুক্তভোগী কৃষকেরা।

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা এবং নড়াইল সদর উপজেলার সীমান্ত দিয়ে বয়ে গেছে কাঠুরিয়া খালটি। খালের দক্ষিণ পাশে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জামদিয়া ইউনিয়ন এবং উত্তর পাশে নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর ও শেখহাটী ইউনিয়ন।

গত ২৫ মার্চ সরেজমিনে দেখা গেছে, বিলের দক্ষিণে বাঘারপাড়া উপজেলার বাকড়ী এলাকা এবং পশ্চিমে ঘোড়ানাচ বিল। বিলের দক্ষিণ অংশ কিছুটা উঁচু। সেখানে বেশ কয়েকটি পুকুর কেটে মাছ চাষ করা হচ্ছে। কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি খননের জন্য খালটির পূর্বের অংশ বাঁধ দিয়ে সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে ফেলা হয়েছে। এতে পানি শুকিয়ে গেছে। প্রায় পুরো বিল ছেয়ে আছে কচুরিপানা, বিভিন্ন আগাছা আর হোগলাগাছে।

বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে খালের ওপর দিয়ে চলে গেছে নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটী-তুলারামপুর সড়ক। উপজেলার হাতিয়াড়া এলাকায় খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে হাতিয়াড়া সেতু। সেতুর মুখে খাল অনেকটা উঁচু হয়ে আছে। সেতু থেকে বিলের দিকে ছোট নালার মতো হয়ে চলে গেছে খালটি।

এ সময় কথা হয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তাঁরা জানান, বিলে প্রায় এক হাজার বিঘার মতো জমি আছে। এই জমি খুবই উর্বর। কাঠুরিয়া খালের প্রায় চার কিলোমিটার বিলের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার এলজিইডির এবং প্রায় ৮০০ মিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)। আগে খালে জোয়ার–ভাটা হতো। খাল দিয়ে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি বিলে ছড়িয়ে পড়ত। জমি উর্বর হতো। খাল দিয়ে পানি বের হওয়ার পর শীতের শেষে বিলটি শুকিয়ে যেত। বিলে তখন বোরো ধানের চাষ হতো। প্রচুর ধান হতো। স্থানীয়ভাবে ‘বোরো ধানের ভান্ডার’ নামে পরিচিত ছিল বিলটি।

তাঁরা আরও বলেন, প্রায় সাত বছর আগে হাতিয়াড়া এলাকায় খালের ওপর সেতু নির্মাণ করার সময় খালে আড়াআড়ি মাটির বাঁধ দেওয়া হয়। সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার পরও মাটির বাঁধটি অপসারণ করেননি ঠিকাদার। বাঁধের কারণে খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় খাল দিয়ে বিলের পানিনিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে বিল কাঠুরিয়া। সেই থেকে বিলে ধান চাষ হচ্ছে না। কয়েক দিন আগেও বিলের কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর আবার কোথাও বুকসমান পানি ছিল। সম্প্রতি সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে ফেলায় বিলটি শুকিয়ে গেছে।

বিলে দেড় বিঘা (৪৮ শতকে বিঘা) জমি আছে নড়াইল সদর উপজেলার বেনাহাটী গ্রামের কৃষক সুকান্ত গোস্বামীর (৩৬)। তিনি বলেন, আগে বোরো মৌসুমের আগে বিল শুকিয়ে যেত। বিলে একটিমাত্র ফসল বোরো ধান হতো। বিলের জমি খুবই উর্বর। বিল কাঠুরিয়ার জমিতে আগে জমিতে প্রচুর পরিমাণে বোরো ধান হতো। কিন্তু হাতিয়াড়ায় সেতু করার পর থেকে বিল সব সময় জলাবদ্ধ থাকে।

বাঘারপাড়া উপজেলার বাকড়ী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক উজ্জ্বল বিশ্বাস (৬৩) বলেন, তাঁরা শুনেছেন, এলজিইডি প্রায় দেড় কিলোমিটার খাল খনন করছে। কিন্তু মূল সমস্যা হাতিয়াড়া সেতু থেকে হাতিয়াড়া শ্মশান পর্যন্ত ওই ৮০০ মিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ড খালের এই অংশ খনন না করলে বিলের জলাবদ্ধতা দূর হবে না।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নড়াইল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ কুমার কুন্ডু বলেন, তাঁরা খালটির ১ কিলোমিটার ৬০০ মিটার খনন করবেন। এ জন্য সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে খালটি শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে কাদা থাকায় খালটি যন্ত্র দিয়ে খনন করা যাচ্ছে না। খালের ভেতরটা শুকিয়ে গেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে। হাতিয়াড়া সেতুর নিচের মাটির বাঁধটি অনেক আগের। বাঁধটিও অপসারণ করা হবে। তবে খালের হাতিয়াড়া সেতু থেকে হাতিয়াড়া শ্মশান পর্যন্ত অংশ খনন করা দরকার। খালের ওই অংশ এলজিইডির নয়।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড নড়াইল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন বলেন, ‘এই মুহূর্তে ওই এলাকায় তাঁদের কোনো প্রকল্প নেই। এ জন্য বিল কাঠুরিয়ায় খাল খনন করা হচ্ছে না। তবে এলজিইডি খাল খনন করছে। আমরা তাঁদের আমাদের অংশ খনন করতে বলেছি। এলজিইডি যদি খনন করতে না পারে, তবে পরে আমরা একটা প্রকল্প নিয়ে খালটি খনন করব।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, খালের মুখটি নড়াইলে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নড়াইলের উপপরিচালকের সঙ্গে কথা বলবেন।