সুনামগঞ্জের তিন উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতারা জয়ী, ছিল নানা হিসাব-নিকাশ ও ‘খেলা’

খায়রুল হুদা, সাদাত মান্নান ও আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়াছবি: সংগৃহীত

সুনামগঞ্জে চতুর্থ ধাপে গতকাল বুধবার তিনটি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট হয়েছে। জেলার রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে সদর উপজেলা এমনিতেই আলোচনায় ছিল। এখানে ‘তিন যুব নেতার’ ভোটের লড়াই নিয়ে ছিল ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা।

অন্য দুটির মধ্যে শান্তিগঞ্জ উপজেলায় সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম মান্নানের ছেলে প্রার্থী ছিলেন। নবগঠিত মধ্যনগর উপজেলায় প্রথম নির্বাচন এবং সেখানে পুলিশের এক শীর্ষ কমকর্তার ভাই প্রার্থী থাকায় সেটিও ছিল অনেকের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রে।

এ তিন উপজেলায় যাঁরা চেয়রাম্যান পদে জয়ী হয়েছেন, তাঁরা নানা কারণে আলোচিত ছিলেন। তাঁদের রাজনৈতিক ও পারিবারিক প্রভাব আছে এলাকায়। তাঁরা তিনজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মাঠপর্যায়ে তাঁদের নিয়ে রাজনীতির নানা সমীকরণ ছিল। নেতাদের নানা হিসাব-নিকাশ ও ‘খেলা’ ছিল এই ভোট ঘিরে। এর প্রভাব জেলা আওয়ামী লীগের আগামী দিনের রাজনীতিতে পড়বে, এমন আভাস পাওয়া গেছে ভোটের ফল ঘোষণার পরপরই। বিশেষ করে সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-দূরত্বের সৃষ্টি করতে পারে।

সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে টানা দ্বিতীয়বারের মতো জয়ী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান খায়রুল হুদা (চপল)। জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি। তাঁর বড় ভাই নুরুল হুদা সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, খায়রুল হুদা বিপুল ভোটে জয়ী হলেও গত নির্বাচনের চেয়ে এবার তাঁদের পরিশ্রম করতে হয়েছে বেশি। পরিবারের সদস্যরা ভোটের মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। শেষমেশ নির্বাচন এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠবে, এটা অনেকে চিন্তা করেননি। খায়রুল হুদা এবার ভোট পেয়েছেন ৩৬ হাজার ৩১১টি। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফজলে রাব্বী ওরফে স্মরণ পেয়েছেন ২৫ হাজার ৪৭০ ভোট।

জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় উপসাংস্কৃতিক সম্পাদক ফজলে রাব্বী এবার প্রথম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বয়সে তরুণ ফজলে রাব্বী আওয়ামী পরিবারের সন্তান। প্রথম নির্বাচনেই নিজেকে বেশ জোরেশোরে তুলে ধরেছেন। ফজলে রাব্বীর মা শামসুন্নাহার বেগম জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সুনামগঞ্জ-মৌলভীবাজার জেলার সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।
আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনিষ কান্তি দে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) ছিলেন। তিনি সুনামগঞ্জ পৌরসভার দুবারের সাবেক কাউন্সিলর। এবার নিয়ে তিনি সদর উপজেলায় তৃতীয়বারের মতো অংশ নিলেন। এবার তিনি পেয়েছেন ১৬ হাজার ৬২০ ভোট।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে এবার বেশি আলোচনার কারণ ছিল সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও সুনামগঞ্জ-৩ আসনের (শান্তিগঞ্জ ও জগন্নাথপুর) বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের ছেলে সাদাত মান্নান প্রার্থী হওয়ায়। সাদাত মান্নান শান্তিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যের একটি ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। অনেকেই তাঁর প্রার্থিতাকে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা এই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালামের ‘বাড়া ভাতে ছাই দেওয়া’ হিসেবে দেখেছিলেন। ফলাফলেও তা–ই হয়েছে। প্রথমবারই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে চমক দেখিয়েছেন সাদাত মান্নান। তিনি পেয়েছেন ৪০ হাজার ৯৮৭ ভোট।

শান্তিগঞ্জের বাসিন্দা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম সব সময় মাঠে ছিলেন। কিন্তু সাদাত মান্নান প্রার্থী হওয়ায় ধীর ধীরে ভোটের মাঠে দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। আবুল কালাম পেয়েছেন ১৯ হাজার ২৫৫ ভোট। এখানে আরেক প্রার্থী ছিলেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বোরহান উদ্দিন ওরফে দোলন। তিনি পেয়েছেন চার হাজার ৯৮ ভোট। তিনিও একাধিকবার এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

মধ্যনগর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আটজন। এর মধ্যে জয়ী হয়েছেন আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া। তিনি পুলিশের অতিরিক্ত  উপমহাপরিদর্শক আবদুল বাতেনের ভাই। ভোটের আগের প্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রার্থীর পক্ষ থেকে এখানে ভোটে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ছিল। আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া পেয়েছেন ১২ হাজার ৮৫৩ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সাইদুর রহমান পেয়েছেন ৯ হাজার ৯১৬ ভোট।

এ প্রসঙ্গে সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী বলেছেন, তিনটি উপজেলা নিয়েই আলোচনা ছিল বেশি। ভোটের আগে প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে একাধিক অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ভোটের দিন টুকটাক কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে, এটাই স্বস্তির বিষয়।