নৌকা চালিয়ে খাল পাড়ি দিয়ে স্কুলে যায় শিশুরা 

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর মোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ার চর ও উত্তর চর মোন্তাজ গ্রামের শিশুরা এভাবে নিজেরাই নৌকা চালিয়ে ঝুঁকি নিয়ে খাল পারাপার হয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করছে
ছবি: প্রথম আলো

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল আক্তার। লেখাপড়া করছে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর মোন্তাজ ইউনিয়নের মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলে যেতে প্রতিদিনই জান্নাতুলকে ছোট্ট একটি ডিঙিনৌকায় একটি বড় খাল পার হতে হয়। বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতে বাইলাবুনিয়া খালের ওপর বাঁশের সাঁকো ছিল। লবণাক্ততার কারণে সেটি ভেঙে গেছে। সাঁকোটি পুনরায় আর নির্মাণ করা হয়নি। নির্মাণ হয়নি সেতুও। এখন নৌকাই তাদের ভরসা।

১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, একটি ছোট্ট ডিঙিনৌকায় জান্নাতুলসহ কয়েকজন শিশু বাইলাবুনিয়া খাল পাড়ি দিয়ে তাদের বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। তাদের সবার বাড়ি খালের উত্তর পাড়ে দিয়ার চর ও উত্তর চর মোন্তাজ এলাকায়। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ডিঙিনৌকায় উঠিয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছেন, কখন নৌকাটি তীরে পৌঁছাবে, সেই অপেক্ষায়।

খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জান্নাতুলের বাবা দেলোয়ার মাতুব্বর বলেন, ‘আগে বাঁশের সাঁকো ছিল। কিন্তু সাঁকো ভেঙে যাওয়ার পর আর কেউ সাঁকো নির্মাণ করেননি। এখন মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে হচ্ছে নৌকায়। স্কুলে থেকে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত টেনশনে থাকতে হয়। এভাবে স্কুলে যাওয়াই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

আরেক অভিভাবক জাকির হাওলাদার বলেন, ‘আমার দুই ছেলে মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। ছোট ছেলে আরাফাত হাওলাদার দ্বিতীয় শ্রেণিতে ও বড় ছেলে ইউসুফ হাওলাদার পঞ্চম শ্রেণিতে। গত বছর আরাফাত খাল পার হতে গিয়ে নৌকা থেকে খালে পড়ে গেছে। আমি খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলেছি।’ তিনি বলেন, এই খালে একটি সেতু হলে তাঁদের দুই চরের ছেলেমেয়েরা নিরাপদে স্কুলে পড়তে যেতে পারত।

উনিয়নের দিয়ার চর ও উত্তর চর মোন্তাজের একটি অংশ থেকে অন্তত ৬০ শিশু এভাবে ডিঙিনৌকায় খাল পারাপার হয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে। ওই খাল পারাপারে এখন তিনটি নৌকা রয়েছে। একটি মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সালমা বেগম নিজের যাতায়াতের জন্য কিনেছেন। অপর দুটি স্থানীয় জেলেদের। তিনটি নৌকাতেই শিশু শিক্ষার্থীরা পারাপার হচ্ছে। কোনোটাতেই টাকা লাগে না।

চর মোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ার চর ও উত্তর চর মোন্তাজ থেকে ৬০ শিশু ডিঙিনৌকায় খাল পারাপার হয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে।

বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, দোতলা সাইক্লোন সেন্টার কাম বিদ্যালয় ভবনটিতে ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি চলছে। নৌকায় খাল পার হয়ে আসা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মোসা. কেয়ামনি বলে, ‘সাঁকো ভেঙে পড়ার পর কিছুদিন পাঁচ কিলোমিটার ঘুরে পায়ে হেঁটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। এতটা পথ হাঁটতে খুব কষ্ট হতো। তাই নৌকার ব্যবস্থা হয়েছে। এখন নৌকায় খাল পার হয়ে স্কুলে আসতে হচ্ছে। আমরা নিজেরাই নৌকার বইঠা চালাই। নৌকায় পারাপারের কারণে আমাদের এলাকার অনেকেই এখন স্কুলে যাচ্ছে না। একটি সেতু থাকলে এই কষ্ট হতো না।’

সহকারী শিক্ষক সালমা বেগম বলেন, তিনিও আগে বাইলাবুনিয়া খালের ওপর বাঁশের সাঁকো পার হয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতেন। করোনার সময় স্কুল বন্ধ ছিল। সেই সময়ে বাঁশের সাঁকোটি ভেঙে যাওয়ার পর আর মেরামত হয়নি। প্রায় এক বছর ধরে তিনি নৌকায় যাতায়াত করছেন। অনেক সময় নৌকাও পাওয়া যায় না। তাই বিদ্যালয়ে সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকার জন্য তিনি নিজে একটি নৌকা কিনে নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরাও অনেক সময় তাঁর নৌকায় খাল পেরিয়ে বিদ্যালয়ে আসছে।

মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রুহুল আমিন বলেন, ২০০২ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে নিয়মিত সাড়ে তিন শর মতো শিক্ষার্থী ছিল। এর মধ্যে প্রায় দুই শর মতো শিক্ষার্থীই আসত ওই দুই চর থেকে। করোনার সময় স্কুল বন্ধ ছিল, তখনই সাঁকোটি ভেঙে যায়। এর পর থেকেই স্কুলের উত্তর পারের দুই চরের শিক্ষার্থীদের নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে অথবা পাঁচ কিলোমিটার পথ ঘুরে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসতে হচ্ছে। যাতায়াতে ভোগান্তির কারণে স্কুলে শিক্ষার্থী কমে গেছে। বর্তমানে তাঁর স্কুলে শিক্ষার্থী ১৪৪ জন। এখন ওই দুই চর থেকে ৬০ জনের মতো শিক্ষার্থী আসছে। 

রাঙ্গাবালী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এভাবে ডিঙিনৌকায় শিশুরা ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে জেনে খুব খারাপ লাগছে। ওখানে যাতে একটি সেতু নির্মিত হয়, এ ব্যাপারে এলজিইডি কার্যালয়ে কথা বলব।’

এলজিইডি রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। সেতু নির্মাণের জন্য প্রকল্প তৈরি করে প্রধান কার্যালয়ে প্রস্তাবনা পাঠাব।’