তিন প্রজন্মের মাঝি পরিবার রফিকুলরা

শনিবার সকাল সাতটা। রূপসার ঘোলা জলে সবে ভাটার টান শুরু হয়েছে। একটু পরপর আকাশে বদলে যাচ্ছে মেঘের রং। কখনো কালো মেঘ ঢেকে দিচ্ছে সকালের সূর্যকে। আবার কখনো নীলাভ সাদাটে আকাশে পেঁজা তুলার মতো মেঘ জড়ো হচ্ছে। পরক্ষণেই আবার টুকরা টুকরা হয়ে এলোমেলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে।

মুখে পানে আর হাতে পানের বোটায় চুন নিয়ে অনেকটা অলস ভঙ্গিতে লঞ্চঘাটের পন্টুনের চেয়ারে বসে আছেন রফিকুল ইসলাম। খুলনার নতুন বাজার লঞ্চঘাটের পন্টুনের গা ঘেষে যেসব ট্রলার ভেড়ানো, সেগুলোর একটির মাঝি তিনি। থাকেন রূপসার নৈহাটি ইউনিয়নের রামনগর অধুনা রহমতনগর গ্রামে। ৩৪ বছর ধরে এ ঘাটে মাঝিগিরি করছেন।

কথায় কথায় জানা গেল, খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দেওড়া গ্রামে তাঁদের বাড়ি। দেশ স্বাধীনের পর এলাকায় অভাব–অনটন শুরু হলে তাঁর বাবা খুলনা চলে আসেন। এরপর মা–বাবা দুজন মিলে রূপসার এক চালকলে কাজ করতেন। কিছুদিন পর এ ঘাটের মাঝি তালিকায় নাম অনর্ভুক্ত করেন তাঁর বাবা। তখন অবশ্য ঘাটে নৌকার চল ছিল। বাবা এখন নেই। রফিকুল, তাঁর ভাই, ছেলে প্রজন্মের এ পেশাকে বয়ে বেড়াচ্ছেন।

রফিকুল বলেন, ‘বড় ভাইকে কোলে নিয়ে বাবা খুলনা আসেন। এখানে আসার বছর পনের পর আমার জন্ম হয়েছে। বাবার হাত ধরে বড় ভাই এ কাজ শুরু করে। এরপর আমি একটু বুঝতে শিখলে মানে সাত-আট বছর বয়স থেকেই এ কাজে ঢুকে পড়ি। আর এত বছর ধরে যা শিখেছি, যা করছি, তাতে আর এখান থেকে ওঠার কায়দা নেই। ভালো থাকতে গেলে তো কর্মের বিকল্প নেই। বাকি জীবন হয়তো এভাবেই ঘাটে কাটাতে হবে।’

এখন নতুন বাজার লঞ্চঘাটের জৌলুশ নেই বললেই চলে। অনেকটা নির্জন হয়ে গেছে ঘাট। অথচ ১০-১৫ বছর আগেও এ ঘাটে পা দেওয়ার জায়গা থাকত না। নতুন বাজারে মাছের বড় আড়ত ছিল। আড়তে সব সময় লোক থাকত। দক্ষিণের সব মাছ লঞ্চে করে এ ঘাটে নামত। আবার কয়রাসহ দক্ষিণের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র উপায় ছিল লঞ্চ। কাজেই রমরমা থাকত এ লঞ্চঘাট এলাকা। রফিকুল বলেন, ‘মাছের আড়ত রূপসা ফেরিঘাট এলাকায় চলে গেছে।

এর পর থেকে নতুন বাজার ঘাট কানা হয়ে গেছে। আমাদের আয়ও কমেছে। আবার সড়ক যোগাযোগ ভালো হওয়ায় লঞ্চে যাত্রী কমেছে। আড়াই ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছাতে পারলে লঞ্চে কেন সাত ঘণ্টা বসে থাকবে মানুষ?’

আলাপে আলাপে জানা গেল, রফিকুলের এখন পাঁচজনের সংসার। অল্প বয়সেই দুই ছেলে রোজগার শুরু করেছে। এক ছেলে মাঝেমধ্যে ট্রলার চালায় আর অন্য সময় যে কাজ পায় তাই করে। অন্য ছেলে ড্রেজারের বালুর তোলার কাজ করে। মেয়েটা স্কুলে পড়ে।

নতুনবাজার লঞ্চঘাটের সব মাঝিই বলতে গেলে কয়রার মানুষ। ঘাটে তালিকাভুক্ত ৫১ জন মাঝি আছেন। তবে ট্রলার চলে বর্তমানে ২৮টি। দিন–রাত ঘাটে ট্রলার চলে। ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত রূপসাপারের লোকজন বিভিন্ন কাজের তাগিদে পার হয়ে শহরে আসেন। কেউ শহরের দোকানপাটে কাজ করেন। কেউ পাথর–বালু টানেন। কেউ ডকইয়ার্ডে কাজ করেন, কেউ আবার চাকরিজীবী।

বেলা তিনটার পর থেকে শহর থেকে আবার মানুষ ফিরতে শুরু করেন। মাঝের সময়টাতে লোকজন কম পার হন। আটজন নিয়ে ট্রলার পার করার নিয়ম। জনপ্রতি ভাড়া পাঁচ টাকা। মোট কথা প্রতিবারে একটা ট্রলার নিয়ে পার হলে ৪০ টাকা আয় হয়।

ভোর ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ঘাটে পারাপারের কাজ করেন রফিকুল। ঘাটে চাঞ্চল্য কমে যাওয়ায় কোনো দিন হাজারখানেক, কখনো একটু বেশি আয় হয়। প্রতিদিন ডিজেল খরচ হয় সাড়ে ৩০০ টাকার মতো। ট্রলারের জন্য ভাড়া দিতে হয় ২০০ টাকা। দুপুরে বাসায় গিয়ে খেলেও ঘাটে থাকতে হাত খরচ হয় ৫০ টাকার মতো। সব বাদে দিনে ৪০০ টাকার মতো রোজগার হয় রফিকুলের।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে সংসার চালানো বেশ কষ্টের মন্তব্য করে রফিকুল বলেন, ‘আতপ চাল খাই। আগে যে আতপ ৩৮ টাকা কেজি কিনতাম, এখন সেটি ৪৮ টাকা। জিনিসপাতির যে দাম তাতে চলাই মুশকিল।’ আপনার পরিবারে তো আয়ের লোক তিনজন।

এ কথা বলতেই রফিকুল পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলে ওঠেন, ‘ছেলেরা আয় করে। তাদের বিষয় তো আলাদা। আমি সারা দিন কী করলাম, সেটাই হিসাব। আমার আর ছেলেদের আয় মিলিয়ে হয়তো কিছুটা সচ্ছল আছি। এ ঘাটের অনেকে আছে, ভীষণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।’

কথা বলার মধ্যেই পারের জন্য দু–একজন করে আসতে থাকেন। আগে থেকে অপেক্ষা করা বয়স্ক এক যাত্রী মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করছিলেন, মাঝি ছাড়বা কখন?