বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নবান্নের আয়োজনে বাংলার ঐতিহ্যের পরিচয়
অগ্রহায়ণ মাস বাঙালির গ্রামীণ জীবনে নিয়ে আসে উৎসব ও আনন্দের বিশেষ আবেশ। নতুন ধান ঘরে তোলার পর সেই চালের প্রথম ভাত, পিঠাপুলির ঘ্রাণ আর মিলেমিশে খাওয়ার সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে নবান্ন উৎসব বাঙালির কৃষিভিত্তিক সমাজ ও সংস্কৃতির এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। তবে আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা ও যান্ত্রিকতায় এ উৎসব অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। তবু শিকড়ের টান ধরে রাখতে ও তরুণ প্রজন্মকে বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর ধরে আয়োজন করা হচ্ছে নবান্ন উৎসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘পদাতিক’ এ আয়োজন করে আসছে।
এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ প্রাঙ্গণে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী নবান্ন উৎসব ‘নব ছন্দে নবান্ন’। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুরু হওয়া এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসজুড়ে রঙিন পোশাকে সজ্জিত শিক্ষার্থীরা, গানবাজনার সুর, পিঠার সৌরভ আর গ্রামীণ মোটিফে সাজানো স্টল মিলিয়ে তৈরি হয় চিরায়ত গ্রামীণ উৎসবের উষ্ণ আবহ।
সন্ধ্যায় পদাতিক সদস্যদের পরিবেশনায় পঞ্চকবির গান দিয়ে উৎসবের উদ্বোধনী হয়। এরপর একে একে পরিবেশিত হতে থাকে কোরাস গান, একক সংগীত, নাচ, কবিতা আবৃত্তি ও নাট্যাংশ। গভীর রাত পর্যন্ত চলে আয়োজনের বিভিন্ন পরিবেশনা। আজ শুক্রবারও চলবে এ উৎসব।
সংগঠনটির উদ্যোগে মুক্তমঞ্চের সামনে সাজানো হয় পিঠা, ঐতিহ্যবাহী খাবার, হাতে তৈরি সামগ্রী ও গ্রামীণ জীবনধারাকে উপস্থাপন করা ১৪টি স্টল। চিতই, ভাপা, পাটিসাপটা, দুধ–চিড়াসহ নানা ধরনের শীতের পিঠায় দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ আকর্ষণ ছিল শিক্ষার্থীদের হাতে তৈরি চুড়ি ও বাহারি রঙের গয়না।
উৎসবের প্রথম দিনে সন্ধ্যায় পদাতিক সদস্যদের পঞ্চকবির গানের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় অনুষ্ঠানমালার। এরপর একে একে পরিবেশিত হয় কোরাস সংগীত, একক সংগীত, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি ও নাট্যাংশ। শিক্ষার্থীদের শৈশবের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিতে মেলায় যুক্ত করা হয় নাগরদোলা ও শিশুদের ট্রেন। এসব আয়োজন শিশুদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক দর্শনার্থীদের মধ্যেও বাড়তি উৎসাহ তৈরি করে।
মেলায় আসা শিক্ষার্থী সুমাইয়া ইসলাম বলেন, ‘সারা বছর ক্লাস, পরীক্ষার চাপের মধ্যে এমন গ্রামীণ উৎসব আমাদের মানসিক স্বস্তি ও ভিন্ন রকম আনন্দের উপলক্ষ। তাই সারা বছর আমরা এ উৎসবের জন্য অপেক্ষায় থাকি।’
শিক্ষার্থী শেখ সুস্মিতা ও ইন্দ্রাণী বিশ্বাস বলেন, ‘বাঙালির এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। এ সংস্কৃতি আমাদের জাতিসত্তার শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এরই অংশ নবান্ন। কিন্তু নগরজীবনে এসব উৎসব এখন কেবলই রূপকথার স্মৃতির মতো। পদাতিক প্রতিবছর বৃহৎ পরিসরে এ আয়োজন করে আমাদের সেই সংস্কৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এটা এক অনন্য উদ্যোগ, যা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে একাত্ম করে।’
আরেক শিক্ষার্থী তানভীর হোসেন বলেন, ‘আমরা চাই পদাতিক এ আয়োজন অব্যাহত রাখুক। আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এমন উৎসব বেশি বেশি আয়োজন করে বাঙালির হারানো ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখুক।’
উৎসবের দ্বিতীয় ও শেষ দিন আজ শুক্রবার। দিনভর সাংস্কৃতিক আয়োজনের পাশাপাশি সন্ধ্যায় পরিবেশনা থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড বনসাই, ব্যাবিলন ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ব্যান্ড দল। এ আয়োজনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে।
নবান্ন শুধু নতুন ধান বা পিঠাপুলির উৎসব নয়, এটি বাঙালির অস্তিত্বের উৎসব উল্লেখ করে আয়োজক সংগঠন পদাতিকের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আল আমিন বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম যাতে নিজের সংস্কৃতির শিকড় ভুলে না যায়, সে জন্যই আমাদের এ আয়োজন। নবান্ন একটি উদার, সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব—যার মূল শক্তি মিলন, সম্প্রীতি, আনন্দ আর ভাগাভাগির মানসিকতা। এ ধরনের আয়োজন শিক্ষার্থীদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে এবং সমাজে ইতিবাচক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়। তাই আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে প্রতিবছরই এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা।’