সীতাকুণ্ডে মুখোশধারী বাহিনীর আতঙ্কে বিএনপি নেতাদের পরিবার
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় গত ২০ দিনে চার বিএনপি নেতার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে একদল মুখোশধারী। প্রতিটি বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ধরন একই। চারটি ঘটনাতেই গভীর রাত কিংবা ভোরের দিকে মুখোশপরা দুর্বৃত্তরা এসে তিন নেতার বাড়িতে ও এক নেতার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এরপর জাহাজের সিগন্যাল লাইট নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। পরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর চালিয়েছে।
সব কটি ঘটনা পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে ঘটিয়ে দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে। আচমকা এ ধরনের ভয়ংকর ঘটনা দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন হামলার শিকার পরিবারের সদস্যরা।
ভুক্তভোগী বিএনপি নেতা ও তাঁদের স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেছেন, অতীতে তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল, পুলিশ কিংবা বিরোধী দলের সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু কখনো বাড়িঘরে হামলা হয়নি। এখন তাঁরা এমনিতেই পুলিশের গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারছেন না। এর ওপর মুখোশধারী বাহিনীর বাড়িতে চালানো হামলায় পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিকট শব্দে ককটেলের বিস্ফোরণের ঘটনায় শিশুরা হঠাৎ আঁতকে উঠে কান্নাকাটি করছে।
বিএনপি নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত শনিবার রাতে সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলমগীরের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এর এক সপ্তাহ আগে ১৩ নভেম্বর ভোর চারটায় দিকে মুখোশধারী ১৫ থেকে ২০ জন দুর্বৃত্ত সীতাকুণ্ড পৌরসভা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার ৩ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সামশুল আলম আজাদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে।
গত ৮ নভেম্বর ভোরে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সোনালী সিএনজি ফিলিং স্টেশনে একই কায়দায় হামলা ও ভাঙচুর করে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এর আগে গত ২৮ অক্টোবর রাতে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের বাড়িতেও একই কায়দায় হামলা চালানো হয়। কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের বড় ভাই কাজী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন সীতাকুণ্ড উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব।
২০ দিনের ব্যবধানে চারটি হামলার ঘটনা ঘটলেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ জানানো হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা কেউ অভিযোগ করতে থানায় যাচ্ছেন না।
বিএনপি নেতাদের দাবি, পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় এসব হামলা হচ্ছে। যখন হামলার ঘটনা ঘটছে, হামলাকারীদের পেছন থেকে নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ। প্রতিটি ঘটনার সময়ে পুলিশ ঘটনাস্থল এলাকায় ছিল বলে এলাকাবাসীরা তাঁদের জানিয়েছেন।
তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় এসব হামলা হচ্ছে। যখন হামলার ঘটনা ঘটছে, হামলাকারীদের পেছন থেকে নিরাপত্তা দিচ্ছে পুলিশ। প্রতিটি ঘটনার সময়ে পুলিশ ঘটনাস্থল এলাকায় ছিল বলে এলাকাবাসীরা তাঁদের জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগী বিএনপি নেতা কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচতে তিনি ও তাঁর ভাই উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব কাজী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে বাড়িঘরে থাকছেন না। বাড়িতে তাঁদের আরেক ভাই পরিবার নিয়ে থাকেন। ঘটনার দিন তিনিও বাড়িতে ছিল না। ওই ঘরে তাঁর বৃদ্ধ মাসহ নারী ও শিশুরা হঠাৎ গভীর রাতে ককটেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। সে আতঙ্ক বেশ কয়েক দিন ছিল। তিনি স্থানীয়ভাবে খবর পেয়েছেন, যখন তাঁদের বাড়িতে মুখোশধারীরা হামলা করছিল, তখন ওই এলাকায় পুলিশের টহল ছিল। এ জন্য তিনি মনে করেন, পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় হামলা হয়েছে। সে জন্য পুলিশের কাছে গিয়ে আর আইনের সুরক্ষা চাননি।
শনিবার রাতে হামলা হয় কুমিরা যুবদল সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীরের বাড়িতে। তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের ভয়ে তাঁর স্বামী দুই মাস ধরে বাড়িতে থাকেন না। তাঁর ১১ মাসের একটি শিশু আছে। হঠাৎ গভীর রাতে বাড়িতে বিকট শব্দে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। তিনি ও তাঁর শিশুসন্তানেরা ভয়ে আঁতকে ওঠেন। মুখোশধারীরা তাঁর কক্ষের দিকে একের পর এক জাহাজের সিগন্যাল লাইট নিক্ষেপ করেন। পরে পাথর নিক্ষেপ করে তাঁর ঘরের জানালা ভাঙচুর করেন। এ সময় তিনি ও শিশুরা আতঙ্কে জড়সড় হয়ে কাঁদছিলেন। কেউ তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি।
থানায় গিয়ে আইনগত ব্যবস্থার আবেদন করেছেন কি না জানতে চাইলে মরিয়ম বেগম বলেন, তাঁদের ঘরে কোনো পুরুষ নেই। তিনি কখনোই থানায় যাননি। ছোট শিশুদের নিয়ে তিনি কীভাবে থানায় যাবেন। কার কাছে অভিযোগ জানাতে হয়, তিনি তা-ও জানেন না।
বাড়িঘরে হামলা হলে নারী ও শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন—এটিই স্বাভাবিক। প্রতিটি ঘটনা তাঁরা স্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে জেনেছেন। কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী থানায় এসে লিখিত অভিযোগ করেননি। তবুও তিনি পুলিশ পাঠিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন।সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ
কুমিরায় যুবদল নেতার বাড়িতে হামলার পর কুমিরা ইউপির চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ হোসেন চৌধুরী তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘কুমিরা ইউনিয়ন যুবদল সভাপতি আলমগীরের বাড়িতে হামলা তাঁদের দলীয় কোন্দলের কারণে হয়েছে। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও পুলিশকে দায়ী করা ঠিক নয়।’
জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িঘরে হামলা হলে নারী ও শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন—এটিই স্বাভাবিক। প্রতিটি ঘটনা তাঁরা স্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে জেনেছেন। কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী থানায় এসে লিখিত অভিযোগ করেননি। তবুও তিনি পুলিশ পাঠিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন।
ওসি বলেন, আইনগত সেবা পাওয়ার অধিকার দেশের সব নাগরিকের আছে। ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেসব ঘটনা পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করার মতো, সেগুলোয় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। কিন্তু এখানে সরাসরি ভুক্তভোগী নিজেই থানায় মামলা করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনার সময় পুলিশের উপস্থিতির বিষয়টি সঠিক নয় জানিয়ে ওসি তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, পুলিশ রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় বদ্ধপরিকর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয়ে এই ধরনের অপকর্ম পুলিশ কখনোই করতে পারে না। ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ না দিলেও ঢালাওভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যাচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তারা সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই ধরনের হামলার ঘটনা শুনেননি জানিয়ে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, যদি ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে আইনগত ব্যবস্থা চাইতে পারেন।