সাত বিয়ে করা রবিজুলের দুই স্ত্রীকে নিয়ে মাতব্বরদের সালিস, যা হলো বৈঠকে
সাতটি বিয়ে করা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছিলেন কুষ্টিয়ার ৩৯ বছর বয়সী রবিজুল ইসলাম। গত বছরের ডিসেম্বরে ওই ঘটনার পর হঠাৎ করে তিন দিন ধরে আবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। এবার তাঁর দুই স্ত্রীকে জোর করে বাড়ি থেকে বের দেওয়ার অভিযোগ করেছেন রবিজুল।
গ্রামের মাতব্বরেরা সালিস করে সাদা স্ট্যাম্পে সই করিয়ে দুই স্ত্রীকে বের করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রবিজুলের। গতকাল শনিবার দুপুরে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের পাটিকাবাড়ি গ্রামের বাজারে ওই সালিসের আয়োজন করেন স্থানীয় মাতব্বরেরা। পাটিকাবাড়ি গ্রামেই রবিজুলের বাড়ি।
রজিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে কলার ধরে সালিস বৈঠকে আনা হয়েছে। মারধরও করা হয়েছে। সালিসে ভরা মজলিশে দুই স্ত্রীর সামনে গালাগাল করা হয়েছে। স্ত্রীদের তালাক না দিলে বাড়িঘরে আগুন ও মারধর করা হবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বাধ্য হয়ে সাদা স্ট্যাম্পে সই করি। এমনকি দুই স্ত্রীকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন মাতব্বরেরা। বিষয়টি আরও সুন্দর করে সমাধান করা যেত, যেটা করা হয়নি।’
যেভাবে সাত বিয়ে
মাত্র ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীকে বিয়ে করেছিলেন রবিজুল। ২০২৩ সালে তিন মাসে তিনটি বিয়ে করেন। এর আগে এক যুগ লিবিয়ায় ছিলেন। সেখানে গিয়েও একটি বিয়ে করেছিলেন। সব মিলিয়ে সাতটি বিয়ে করেন। দোতলা বাড়িতে প্রত্যেক স্ত্রীর আলাদা আলাদা ঘরে খাট, ওয়ার্ডরোব, ড্রেসিং টেবিল, শোকেস, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটরসহ নানা জিনিস দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন।
রবিজুল জানান, কর্মক্ষেত্রে বা ফেসবুকে নারীদের সঙ্গে যোগাযোগের পর তাঁরা বিয়ের সম্পর্কে জড়িয়েছেন। সাত স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সুখে সংসার করছিলেন। গত বছরের ডিসেম্বরে বিয়ের বিষয়টি গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হলে বিষয়টি আলোচিত হন। তখন রবিজুল প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘বড় বউ’ তো সব জানেন। দুই মাস আগে সর্বশেষ যে বিয়ে করেছেন, তাতে তাঁর চার স্ত্রী সাক্ষীও দিয়েছেন। তাঁর সংসারে কোনো অশান্তি নেই।
রবিজুল ইসলাম জানান, তিনি মা-বাবার একমাত্র ছেলে। যখন ছোট, তখনই তাঁর মা ছেলের সাত বউ থাকার মানত করেছিলেন। মায়ের মৃত্যুর আগে তিনি চার স্ত্রীকে দেখে গেছেন। রবিজুলের ভাষ্য, মায়ের স্বপ্ন পূরণ ও ‘গরিব-মিসকিন’ নারীদের সাহায্য করতে তিনি বিয়েগুলো করেছেন। স্ত্রীরা বোনের মতো থাকছেন বা স্বামীর একাধিক বিয়ের বিষয়টি তাঁরা মেনেও নিয়েছেন।
হঠাৎ মাতব্বরদের চাপ
আলোচিত ঘটনার ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। চলতি মাসের প্রথম দিকে গ্রামের মাতব্বর ও ইমামদের মধ্যে বিষয়টি আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চারটি স্ত্রী রেখে বাকিদের তালাক দিতে হবে—স্থানীয় যুবকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন স্ট্যাটাস দেন। এ নিয়ে জুমার নামাজে গ্রামের মসজিদে ইমাম বয়ানও করেন। গ্রামের ২২ প্রধান (মাতব্বর) একসঙ্গে হয়ে ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী চারজন স্ত্রী রেখে বাকিদের তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
সালিস বৈঠক
গতকাল সকাল নয়টার দিকে পাটিকাবাড়ি গ্রামের বাজারে একটি দোকানের সামনে ২২ গ্রামপ্রধানের উপস্থিতিতে সালিস শুরু হয়। সেখানে রবিজুলকে ডেকে আনেন তাঁরা। বৈঠকে সব প্রধানের মূল প্রধানের ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় মাতব্বর নাজিম মণ্ডল। এ সময় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সফর উদ্দিন, ইউনিয়ন যুবলীগের শাখাওয়াত হোসেনসহ অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে শরিয়ত মোতাবেক চারের অধিক স্ত্রী রাখার বিধান না থাকার ইসলামি ব্যাখ্যা দেন মুহতামিম হাফেজ ম. মুফতি আলমগীর হোসাইন। একপর্যায়ে সেখানে রবিজুলের পঞ্চম ও সপ্তম স্ত্রীকে সালিসে ডেকে আনা হয়।
সালিসের দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেন স্থানীয় যুবকেরা। কেউ কেউ ফেসবুকেও সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ) করেন। কয়েক ঘণ্টার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সালিসে মাতব্বরেরা রবিজুলকে বকাঝকা করছেন। কখনো গালাগাল করছেন। একজনকে বলতে শোনা যায়, দুই স্ত্রীকে এই মুহূর্তে তালাক না দিলে বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে। মারধর করা হবে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুটি সাদা স্ট্যাম্পে পৃথক সই করিয়ে নেওয়া হয় রবিজুলের। একই স্ট্যাম্পে দুই স্ত্রীরও পৃথক সই নেন মাতব্বরেরা। এমনকি রবিজুলের কাছ থেকে দুটি এক লাখ টাকার চেকে সই নিয়ে সেই চেক দুই স্ত্রীকে দেওয়া হয়। বলা হয়, এসব নিয়ে এক মিনিটের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে, তা না হলে সমস্যা হবে। নিরুপায় হয়ে দুই স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
রবিজুল বললেন, ‘আমি কখনোই তালাক দিতে চাইনি। মাতব্বরেরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে তালাক দিতে জোর করে স্ট্যাম্পে সই নিয়েছেন। সালিসের পর তাঁরা আমার দুই স্ত্রীকে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছেন। আমাকে কলার ধরে সালিস থেকে বের করে বাড়িতে আনা হয়েছে। আমার মামাকে লাঞ্ছিত করেছেন। আমি এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
রবিজুল আরও বলেন, ‘আমি দুই মাস সময় চেয়েছিলাম। দুই স্ত্রীকে চলার মতো একটা ব্যবস্থা করে স্বাভাবিকভাবে একটা সমাধানের পথ খুঁজছিলাম। কিন্তু সেটা করতে দেওয়া হয়নি। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক চার স্ত্রীর বেশি রাখার বিধান নেই। এটা জানি। কিন্তু দুই স্ত্রীর প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, সেটার বিচার চাই।’
বের করে দেওয়া রবিজুলের স্ত্রী সোহানা আক্তার বললেন, ‘আমাদের বেয়াদব বলা হয়েছে। মাটিতে পুঁতে মাথা বের করে মারার হুমকি দিয়েছে। জোর করে সই করিয়ে নিয়েছে। আমাদের তো সংসারে কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা এখন কোথায় যাব? বাবার বাড়িতে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই। আজ যারা ফতোয়া দিচ্ছে, তাদের অনেকেই আমার বিয়ের সময় বরযাত্রী ছিল। তখন তো কেউ কথা তোলেনি। আজ কেন আমার এত বড় ক্ষতি করছে? অর্ধশতাধিক মানুষের মধ্যে গালাগাল করেছে।’
আরেক স্ত্রী মিতা খাতুন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে মাতব্বরেরা। শত মানুষের সামনে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, আমাদের মারবে, জুতাপেটা করবে। দ্রুত ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আমি তো ঘর-সংসার করতে চাই। আমরা এখন কোথায় যাব? আমাদের দায়দায়িত্ব কে নেবে?’
রবিজুল ইসলাম বলেন, সালিসে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন মাতব্বর শাখাওয়াত হোসেন, লিটন আলী, রহিম মণ্ডল, আমিন মণ্ডল ও সফর আলী। তাঁদের মধ্যে শাখাওয়াত পাটিকাবাড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। সফর আলী একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
স্ত্রীদের তালাক দিতে বাধ্য করতে পারেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সফর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রবিজুল তাঁর দুই স্ত্রীকে তালাক দেবেন বলে নিজেই অঙ্গীকার করেছেন। আমরা তাঁকে বাধ্য করিনি, তাঁকে মারধরও করিনি। সমাজের সব মাতব্বর সিদ্ধান্ত নিয়ে যা হয়েছে, সেটাই করা হয়েছে। মাতব্বরেরা বলেছেন, চারটার বেশি বিয়ে অবৈধ। আমরা তাঁকে বাধ্য করিনি। তাঁর দুই বউ মেনে নিয়েছেন। তাঁদের কাবিন ও খোরপোশ বাবদ দুই লাখ টাকাও দেওয়া হয়েছে।’
পাটিকাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ রেজভি উজ্জামান বলেন, ‘আমি বিভিন্ন মাধ্যমে সামাজিক বৈঠকের বিষয়টি জেনেছি। যেহেতু আমাকে প্রধানেরা বৈঠকে থাকতে বলেননি, তাই আমি এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না।’
সাখাওয়াতের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে ২২ প্রধানদের প্রধান নিজাম মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, সালিসে তিনি কিছুক্ষণ ছিলেন। তখন একটু উচ্চ স্বরে কথা হয়েছে। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকম কথা বলেছেন। কেউ কেউ গালাগালও করেছেন। তবে এভাবে সমাধান না করে আরও সুন্দরভাবে কিছু করা যেতে পারত। আর সব মাতব্বর একমত ছিলেন। তাই তিনি কিছুই বলতে পারেননি।
সালিসস্থলের পাশেই পাটিকাবাড়ি পুলিশ ক্যাম্প। ক্যাম্পের ইনচার্জ উপপরিদর্শক মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত শুক্রবার মসজিদে ইমাম সাহেব বিয়ের বিষয়টি তুলে বয়ান দিয়েছিলেন। তবে সালিসের বিষয়টি জানা নেই। তাঁদের কেউ কিছু বলেননি।
সামাজিক বৈঠকে জোর করে তালাক দিতে বাধ্য করা বা স্ট্যাম্পে সই করিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কুষ্টিয়া আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অনুপ কুমার নন্দী বলেন, সামাজিক বৈঠকে চাপ দিয়ে কাউকে তালাক দিতে বাধ্য করানো আইনের চোখে অপরাধ। বিষয়টি প্রশাসনিক ও আইন মোতাবেক করাই শ্রেয়।