৪৯ বছর পর বিদ্যাপীঠে এসে আবেগে ভাসলেন শামসাদ রেহেনা

বিনোদনগর উচ্চবিদ্যালয়ের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে বন্ধু ইমামুল ইসলাম ও খাদিজা খাতুনের সঙ্গে স্মৃতিকাতর শামসাদ রেহেনা (বাঁয়ে)
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭৫ সাল। সে বছর শামসাদ রেহেনার ব্যাচের সবাই ম্যাট্রিক পাস করে বিদ্যালয় ছাড়েন। বাবার অসুস্থতার কারণে রেহেনা সে বছর পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরের বছর ম্যাট্রিক পাস করে বিদ্যালয়চত্বরে শেষবারের মতো পা দিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন ব্যস্ততায় বিদ্যালয়ে আর কখনো আসা হয়নি তাঁর।

ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে পারেন, এবার ঈদের পর বিদ্যালয়ের পুরোনো বন্ধুরা আসবেন মিলনমেলায়। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে সকালবেলায় প্রিয় বিদ্যাপীঠে চলে আসেন শামসাদ রেহেনা। দীর্ঘ ৪৯ বছর পর তাঁর দেখা হলো বন্ধুদের সঙ্গে। ‘বান্ধবী কেমন আছিস’ বলেই সহপাঠী খাদিজাকে জড়িয়ে ধরেন শামসাদ রেহেনা। দুজনের চোখ থেকে তখন ঝরছে আনন্দাশ্রু।

গতকাল শনিবার দুপুর ১২টায় দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এমন দৃশ্য দেখা গেল। বিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয় হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠান। সকাল সাড়ে ১০টায় হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শুভ উদ্বোধন করেন দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক। পরে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে প্রধান অতিথি রঙিন বেলুন ওড়ান।

১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিনোদনগর উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এসএসসির ৫২টি ব্যাচের ৭৫২ জন নতুন ও সাবেক শিক্ষার্থী অংশ নেন। এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে আসেন তাঁদের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরা। এমন মিলনমেলায় ফেলে আসা শৈশবকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

স্বামী-সন্তানেরা তো আমার পরিবার। কিন্তু স্কুলের বন্ধুবান্ধব তো আত্মার আত্মীয়। তাদের সঙ্গে দেখা না হলেও তারা স্মৃতিতে থাকত সব সময়ই। আজ দেখা হলো, কত ভালো লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের শিক্ষকেরা আজ বেঁচে নেই। বিদ্যালয়ের মাঠে বসে সুখেন স্যার, সনদ স্যার আর কাশেম স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে।
শামসাদ রেহেনা

শামসাদ রেহেনাকে বিদ্যালয়ে সবাই রেবা নামেই ডাকত। তাঁর বাবার বাড়ি বিনোদনগর গ্রামে। তিনি ১৯৭৬ সালে বিনোদনগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর উপজেলার আফতাবগঞ্জ এলাকার আবদুল কাদেরের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। এরপর সংসারের ব্যস্ত সময়ের মধ্যে আর প্রিয় বিদ্যাপীঠে আসার সময় বা সুযোগ কোনোটি হয়নি। ৪৯ বছর পর বিদ্যালয়ের সহপাঠী, বড় ও ছোট ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করতে পেরে শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করেন।

বিনোদনগর উচ্চবিদ্যালয়ের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এসএসসির ৫২টি ব্যাচের ৭৫২ জন নতুন ও সাবেক শিক্ষার্থী অংশ নেন। এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে আসেন তাঁদের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরা
ছবি: প্রথম আলো

আলাপচারিতায় শামসাদ রেহেনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কুলের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে এসে ৫০ বছর পর বান্ধবী খাদিজা ও বন্ধু ইমামুল ইসলামকে দেখতে পেলাম। অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে। স্বামী-সন্তানেরা তো আমার পরিবার। কিন্তু স্কুলের বন্ধুবান্ধব তো আত্মার আত্মীয়। তাদের সঙ্গে শৈশব কেটেছে, কৈশোর কেটেছে। তাদের সঙ্গে দেখা না হলেও তারা স্মৃতিতে থাকত সব সময়ই। আজ দেখা হলো, কত ভালো লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের শিক্ষকেরা আজ বেঁচে নেই। বিদ্যালয়ের মাঠে বসে সুখেন স্যার, সনদ স্যার আর কাশেম স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে।’

শামসাদ রেহেনার সহপাঠী ইমামুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫০ বছরের পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে সকালেই বিদ্যালয় মাঠে হাজির হয়েছি। ম্যাট্রিক পাস করার ৫০ বছর পর আজ আমার বিদ্যালয়ে এলাম। আমাদের অনেক বন্ধুরাই হারিয়ে গেছে। বান্ধবী শামসাদ রেহেনার সঙ্গে ৫০ বছর পর দেখা হলো। বন্ধু লুৎফর, সিদ্দিক ও আসাদকে খুব মিস করি। তারা আজ অনুষ্ঠানে আসতে পারেনি। খাদিজার মোবাইল থেকে স্কুলের মাঠে বসে বন্ধু সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বললাম। আমাদের মতো বুড়োদের জন্য এমন আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়।’

বিদ্যালয়ের হীরকজয়ন্তী উদ্‌যাপন কার্যকরী কমিটির সভাপতি আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিনোদনগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে এখানকার অনেক গুণী-মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের একত্র করতে পেরে আমরা ধন্য। এ বিদ্যালয়ের অনেক পুরোনো শিক্ষার্থী আজ প্রবীণ। তাঁরাও আজ তাঁদের প্রাণের বিদ্যাপীঠের প্রতি ভালোবাসার টানে এক জায়গায় মিলিত হয়েছেন। প্রাণের বিদ্যাপীঠের প্রতি আমাদের এ ভালোবাসা আজীবন থাকবে।’