ওএমএসের দোকান খোলে ৯টায়, লাইন শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে

৩০ টাকা কেজি দরে চাল–আটা কেনার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিয়ে ওএমএসের দোকানের সামনে অপেক্ষা করছেন ক্রেতারা। আজ সোমবার সকালে ময়মনসিংহ নগরের মালগুদাম এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘর থেকে বের হয়েছিলেন সুফিয়া বেগম। ময়মনসিংহ নগরের মালগুদাম এলাকার খোলাবাজারে চাল–আটা বিক্রির (ওএমএস) দোকানের সামনে এসে যখন তিনি লাইনে দাঁড়ান, তখনো ঘন কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আজ সোমবার সকাল পৌনে ১০টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সুফিয়া। সেখানে তখনো শতাধিক মানুষের জটলা।

মালগুদাম এলাকার ছোট্ট একটি দোকানের ভেতর থেকে ওএমএস ডিলারের লোকেরা নাম ঘোষণা করছেন। আর একজন একজন করে এগিয়ে গিয়ে চাল-আটা নিয়ে আসছেন। ৩০ টাকা কেজি দরে একজন গ্রাহক ৫ কেজি করে চাল অথবা আটা কেনার সুযোগ পাচ্ছিলেন।

সুফিয়া বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সকাল ৯টায় শুরু হয় চাল-আটা বিক্রির কার্যক্রম। মালগুদাম এলাকার ডিলারের দোকানে বিক্রির শুরুতে ৫০০ জন ক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জমা নেওয়া হয়। কোটা পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর যাঁরা আসেন, তাঁরা চাল বা আটা পান না। এর ফলে ভোরে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়।

ওই সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করা নগরের শেহড়া এলাকার বাসিন্দা মরিয়াম বেগম বলেন, তিনিও ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল পাওয়ার আশায় নিজের এনআইডি জমা দিয়েছেন। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর তিনি ৫ কেজি আটা পেয়েছিলেন। এরপর আরও কয়েক দিন লাইনে দাঁড়িয়ে আটা পাননি। আজ তিনি চাল নিতে এসেছেন।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পর অনেকেই সংকোচ ভেঙে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ওএমএসের চাল-আটা নিতে আসছেন। সম্প্রতি ময়মনসিংহ নগরের মালগুদাম এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

মালগুদাম এলাকার ওএমএসের ডিলার জানান, তিনি প্রতিদিন ২০০ জনের জন্য ৫ কেজি করে আটা আর ৩০০ জনের জন্য ৫ কেজি করে চাল পান। প্রথমে লাইনের সামনের দিকে থাকা ৫০০ জনের এনআইডি জমা নেন। পরে তাঁদের ক্রমানুসারে ডেকে চাল বা আটা দেওয়া হয়। প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ জন মানুষ ফেরত যান। মাঝেমধ্যে কিছু সুপারিশ আসে। ওই সব সুপারিশের চাল দিতে গিয়ে অনেক সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ কেউ চাল না পেয়ে ফেরত যান।

একই দোকানের পাশ ঘেঁষে জড়ো হওয়া পুরুষদের লাইনে কথা হয় এম সুরুজ আলী নামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে। সকাল ১০টায় তিনি বলেন, সকাল ৭টার আগে এসে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর ঘাড়-কোমড় ব্যাথা করছে। চাল পেতে হলে তাঁকে অন্তত আরও দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। বেলা ১১টার দিকে আবারও ওই এলাকায় গিয়ে সুরুজ আলীকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নগরের ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৭টি ওয়ার্ডে ওএমএসের দোকান রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে সাতটি ট্রাক। যেসব ওয়ার্ডে দোকান নেই, সেসব ওয়ার্ডে ট্রাকগুলো পালাক্রমে চাল আর আটা বিক্রি করে।

আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরের তিনটি ওএমএসের দোকান ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পর নগরে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত পরিবারে সংকট বেড়েছে। যে কারণে অনেকেই সংকোচ ভেঙে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ওএমএসের চাল-আটা নিতে আসছেন। না পেয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ জন ফেরত যান।

থানার ঘাট এলাকায় ওএমএসের চাল নিতে আসা নগরের আমপট্টি এলাকার বাসিন্দা সুশান্ত সাহা বলেন, ‘আমি প্রায় দুই বছর ধরে ওএমএসের চাল কিনি। দিন দিন এ চাল কিনতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেই শুরুর দিকে চাল নিতে লাইনে দাড়াতে সংকোচ করতেন।’

থানার ঘাট এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টায় দেখা যায়, ওএমএসের চাল নিতে আসা একাধিক নারী লাইনে না দাঁড়িয়ে একটু দূরে অবস্থান করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। নির্দিষ্ট আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে সংকোচ ভেঙে ওএমএসের চাল নিতে এসেছেন। তাতে কিছুটা হলেও সংকট কমবে।

থানার ঘাট এলাকার ওএমএসর দোকানের চাল–আটা বিক্রেতা ইব্রাহীম খান বলেন, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি, যেন কেউ ফেরত না যান। দিন দিন ওএমএসের চাল আর আটার চাহিদা বাড়ছে। আমরা আরও বেশিসংখ্যক মানুষের জন্য বরাদ্দ দিতে বলেছি কতৃপক্ষকে।’

ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, কোন জেলায় কী পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হবে, সেটি মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে। এখানে তাঁদের কিছু করার থাকে না। তবে কোনো এলাকায় খুব বেশি চাহিদা দেখা দিলে বিশেষ ব্যবস্থায় বরাদ্দ বাড়ানোর সুযোগ জনপ্রতিনিধিদের হাতে আছে।