জার্মান তরুণের হাতে বর্ণিল চবির শাটল ট্রেন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের গায়ে আঁকতে ব্যস্ত জার্মানির শিল্পী লুকাস জিলিঞ্জার
ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললেই চোখে ভাসে শাটল ট্রেনের ছবি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়ি সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে যে কাউকে। পাহাড়ি ক্যাম্পাসের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করেছে শাটল ট্রেন। দিনে দিনে এই ট্রেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ট্রেনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান ও প্রাক্তন হাজারো শিক্ষার্থীর রয়েছে কতশত স্মৃতি। সেসবের প্রায় অনেকটাই রঙিন আর বর্ণিল।

হাজারো শিক্ষার্থীর স্মৃতির খেরোখাতায় থাকা সে রঙিন শাটল এবার বাস্তবিকই বর্ণিল ও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তা–ও আবার এক ভিন দেশি তরুণের হাতের ছোঁয়ায়। জার্মান তরুণ লুকাস জিলিঞ্জার একাই রাঙিয়ে দিচ্ছেন শাটলকে। তাঁর এই প্রচেষ্টা সাড়া ফেলেছে পুরো ক্যাম্পাসে।

শাটলের বুকে বেঙ্গল টাইগার
ছবি: সৌরভ দাশ

জার্মানি থেকে এসে পাঁচ দিন ধরে একা একা শাটলের বিবর্ণ বগিগুলোতে যেন ‘প্রাণ’ ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এত দিন ধরে মলিন থাকা বগিগুলো হয়ে উঠেছে নানা রঙে রঙিন আর উজ্জ্বল। তাতে ফুটে উঠছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন ঐতিহ্য। চিত্রশিল্পী লুকাসের অদম্য প্রচেষ্টার চিত্র মুঠোফোনে ধরে রাখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

লোকচিত্র আর ভিডিওতে ধারণ করে রাখছেন অন্য রকম এ উদ্যোগের দৃশ্য।
লুকাসের এই চিত্রকর্মে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের নানা ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। রয়েল বেঙ্গল টাইগার—বাংলার আরেক পরিচয়। বাঘের গর্জন করা মুখ দেখলে যে কারও মন একটুর জন্য হলেও চলে যাবে সুন্দরবনে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনও ঠাঁই পেয়েছে শাটলের শরীরে। বনের বিভিন্ন অংশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রঙের কারুকাজে। আবার দেশের অর্থনীতির প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দরও বাদ যায়নি। একটি বগির দেয়ালজুড়ে আঁকা হয়েছে নোঙর করা জাহাজের চিত্র।

গত বৃহস্পতিবার শুরু হয় শাটলকে রাঙানোর কর্মযজ্ঞ। চট্টগ্রাম নগরের বটতলী স্টেশনে সন্ধ্যায় শুরু হয়েছিল শাটলে আঁকাআঁকির কাজ। তবে শাটল ট্রেন সব সময় এক স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে না। তাই লুকাসের ব্যস্ততাও বেড়েছে। যখন যে স্টেশনে বেশি সময় ধরে ট্রেন অপেক্ষায় থাকে, সেখানেই ছুটে যান তিনি।

চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন
ছবি: সৌরভ দাশ

যেমন আজ সোমবার সকালে এসেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের স্টেশন ফতেয়াবাদে। বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত একমনে কাজ করতে থাকেন। তাঁকে সঙ্গ দিতে জার্মানি থেকে এসেছেন স্ত্রী লিভিয়া। তাঁর এ কাজ দেখতে সেখানে জটলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী পূজা দাশ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম রঙিন শাটলে চড়ছি। এর আগে শুধু ছবিতেই রঙিন শাটল দেখেছি। আর আগের বগিগুলোতে শুনেছি রাজনৈতিক সংগঠনের নাম থাকত। তারা তাদের দখল রাখত। এবার ভিন্ন রকম। এটা আনন্দের।’

আজ বেলা দুইটায় ফতেয়াবাদ স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যায় ক্যাম্পাসের উদ্দেশে। এরপর একটু দম ফেলার ফুরসত পান লুকাস। তখন কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রাফিতি আমার আবেগের জায়গা। আমার জীবনের অংশ। বাচ্চা ও তরুণেরা সাবওয়েতে রংতুলির মাধ্যমে গ্রাফিতি আঁকত এবং একসময় সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ত।’

শিল্পকর্মের জন্য বাংলাদেশ ও শাটল ট্রেন বেছে নেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে শিল্পী লুকাস বলেন, ‘বাংলাদেশ খুবই চমৎকার ও সুন্দর একটা দেশ। এ দেশের সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে। আর ট্রেন হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ ক্যানভাস। তাই গ্রাফিতির জন্য ট্রেন একটা আদর্শ জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় শাটলকে আমরা গ্রাফিতির জন্য নির্ধারণ করেছি এর কারণ হলো আমরা কিছু শিক্ষামূলক প্রকল্প নিয়েছি। আমরা চাই, মানুষ যাতে এখান থেকে শিখতে পারে। তরুণেরা সব সময় নতুন কিছু শিখতে চায়। তারা গ্রাফিতি দেখবে, চিন্তা করবে ও এটা নিয়ে গবেষণা করবে। এ জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনকে গ্রাফিতির মিডিয়াম হিসেবে নিয়েছি।’

লুকাসের কাজে সঙ্গী হয়েছেন স্ত্রী লিভিয়া
ছবি: সৌরভ দাশ

প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত বিষয়গুলো বিমূর্ততা ও নান্দনিকতার মাধ্যমে গ্রাফিতিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বলে জানান লুকাস। তিনি এর আগেও তিনবার বাংলাদেশে এসেছেন। জার্মানির বার্লিনে তাঁর বাড়ি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘জার্মান শিল্পী নিজ খরচে এটি করছেন। তিনি যখন আমাদের কাছে শাটল রাঙানোর প্রস্তাব করেন, সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখেই শাটলে চিত্রকর্ম আঁকা হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের ও প্রশংসনীয়’
তরুণ শিল্পী লুকাসের এ কাজে সহায়তা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক অরূপ বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে লুকাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এর পর থেকে শিল্পকর্ম নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে থাকেন। তাঁর অংশ হিসেবে শাটল ট্রেনকে রাঙানো হচ্ছে। এখন একজন শিক্ষার্থী যখন সকালে এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে ক্যাম্পাসে যাবেন, তখন তাঁর মন ভালো হয়ে যাবে।