‘একটা নতুন অ্যাপস আসছোলো। ই-মুভি। অটোরিকশা বেচাবিক্রি করে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা অ্যাপসে ভইরেছিনু। টাকা দেড় লাখ পর্যন্ত উঠেছিল। এক দিনেই চইলে গ্যাছে। ১২ তারিখ থাইক্যা আর ডিপোজিট হচ্ছে না। এখন আর কিছু নাই। পথের ফকির। বাড়িতে কথা শুইনতে হয়, বউয়ের কথা শুইনতে হয়।’ এভাবেই বলছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামে অটোরিকশাচলক রবিউল ইসলাম।
কথিত চীনা অ্যাপে টাকা ঢুকিয়ে ডলার আয় করে রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে সর্বস্বান্ত হয়েছেন রবিউলের মতো রাজশাহীর হাজার হাজার মানুষ। কেউ গরু বিক্রি করেছেন, কেউ নিজের অটোরিকশা বিক্রি করেছেন। কোনো বাবা জানেন না, ছেলে তাঁর অটোরিকশাটা নিয়ে বিক্রি করে টাকা ঢুকিয়েছেন অ্যাপে। বিশেষ করে গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী, ডুমুরিয়া, খেতুর ও ফরহাদপুর গ্রামের যে বাড়িতে স্মার্টফোন আছে, তাদের প্রায় কেউই এই প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারেনি। এর আগেও ‘সিএএফ’ নামের একটি অ্যাপের খপ্পরে পড়ে উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামের মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। রাতারাতি ধনী হতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষ লজ্জায় কোথাও কোনো অভিযোগ করেননি। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
এসব মানুষকে বোঝানো হয়েছিল, এই অ্যাপে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা দিয়ে হিসাব খুলতে হবে। তারপর এই টাকাকে ডলারে পরিণত করার জন্য নগদ বা বিকাশের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে হবে। এরপর সিনেমার টিকিট কিনলেই মুনাফা হিসেবে ডলার যোগ হবে। তবে যে যত বেশি টাকা দিয়ে হিসাব নম্বর খুলবে, তার মুনাফার হার তত বেশি। আবার অন্যজনকে হিসাব নম্বর খুলে দিলেও নিজের হিসাব নম্বরে বাড়তি ডলার যোগ হতো। গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রামে এই অ্যাপ যুবসমাজের মধ্যে ঝড় তুলেছিল। প্রথম দিকে যাঁরা করেছেন, তাঁরা টাকা তুলেছেন। কেউ কেউ অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। জমা হওয়া টাকা বিকাশ বা নগদের মাধ্যমেই ‘ক্যাশ আউট’ করা গেছে। গত সোমবার থেকে তাঁদের হিসাব নম্বর শূন্য হয়ে গেছে। এখন তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
এলাকার চার যুবক এই নতুন অ্যাপের প্রচারণা চালিয়েছেন। তাঁরা লাভবান হয়েছেন। বাড়িগাড়ি করেছেন। আর অন্যদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে গোদাগাড়ীর এই গ্রামগুলোতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্মার্টফোন আছে এমন কোনো বাড়ির মানুষ এই প্রতারণা থেকে রেহাই পাননি। বাড়ির নারীরাও স্বামীকে না জানিয়ে টাকা দিয়েছেন। তাঁরা এখন ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। এ রকম এক নারী পলী বেগম। তাঁর স্বামী একজন প্রতিবন্ধী। অটোরিকশা চালান। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকে কিস্তি দিয়ে ২০ হাজার টাকা সঞ্চয় করেছিলেন। বাড়তি মুনাফার আশায় সেই সঞ্চয় ভেঙে পুরোটাই ‘ই-মুভি অ্যাপে’ জমা করেছিলেন। তাঁর শ্বশুর আছাব শাহ গরু বিক্রি করে ৬৩ হাজার ২৫০ টাকা ওই অ্যাপে ঢোকানোর তিন-চার দিনের মধ্যেই অ্যাপটি বন্ধ হয়ে যায়। পলী বেগম বলেন, তাঁরা এক টাকাও ফেরত পাননি। তিনি স্বীকার করেন অন্যের কথায় লোভে পড়ে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করেছেন। এ জন্য কাউকে কিছু বলতে পারছেন না।
প্রেমতলী গ্রামের বয়স্ক প্রতিবন্ধী মুকল শাহ কথা বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলেন। তাঁর জমানো ৮০ হাজারা টাকার পুরোটাই লাভের আশায় ই-মুভি অ্যাপের মাধ্যমে জমা দিয়েছিলেন। তিনি একটি টাকাও ফিরে পাননি। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্র তার বাবার জমানো ৭০ হাজার টাকা খুইয়েছেন। তাদের বাড়িতে এখন শুধুই হাহাকার।
একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা বললেন অটোরিকশাচালক সাজ্জাদ আলী। তাঁর ছেলে জীবন তাঁকে না জানিয়ে পরিবারের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন অটোরিকশাটি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে সব টাকা ওই অ্যাপে ঢুকিয়েছেন। তাঁরা এক টাকাও ফেরত পাননি। এখন তাঁদের না খেয়ে মারার দশা।
সব বাড়ির গল্প একই রকম বলে জানালেন মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা। তিনি বলেন, তাঁর ইউনিয়নের প্রেমতলী, ডুমুরিয়া, খেতুর পাশের ইউনিয়নের ফরহাদপুর গ্রামের কোনো মানুষ বাদ নেই। কেউ মুখে স্বীকার করছেন, কেউ লজ্জায় বলতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, এলাকার চার যুবক এই নতুন অ্যাপের প্রচারণা চালিয়েছেন। তাঁরা লাভবান হয়েছেন। বাড়িগাড়ি করেছেন। আর অন্যদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
‘চীনা অ্যাপ ই-মুভির’ কার্যক্রম চালানোর জন্য রাজশাহী নগরের সিরোইল কলোনি এলাকায় একটি কার্যালয় খোলা হয়েছিল। মঙ্গলবার থেকে ওই কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। কার্যালয়টির প্রধান ছিলেন আজমল হুদা ওরফে মানিক নামের এক ব্যক্তি। তিনি একজন হোমিও চিকিৎসক। তাঁর বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিলউথরাই গ্রামে। স্থানীয় লোকজন জানান, মানিক একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বলে তাঁরা জানেন।
গত বুধবার রাজশাহী থেকে প্রতারিত মানুষ গিয়ে মানিকের বাড়ি ঘেরাও করেন। এ সময়ের একটি ভিডিও প্রথম আলোর হাতে এসেছে। এখানের একজন মানুষকে বলতে শোনা যায়, তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে গরু বিক্রি করেছেন। আরেকজনকে মুঠোফোন কানে ধরে বলতে শোনা যায়, ‘প্রত্যেকটা মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিছে, প্রত্যেকটা ছাত্রের জীবন ধ্বংস করে দিছে। যে কাজ করিছে, কোনো মানুষ এমন কাজ করে না।’ আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘দুইজন নাকি বিষ খেয়েছে।’ বৃহস্পতিবারও মানিকের বাড়িতে লোকজন ধরনা দিয়েছেন। মানিকের বাবার বয়স প্রায় ৯০ বছর। তিনি কাউকে কিছু বলতে পারেননি।
এদিকে কিছুদিন আগে ই-টাইম নামের একটি অ্যাপে প্রতারিত হয়েছেন রংপুরের ইয়াসিন আরাফাত নামের এক যুবক। ই-মুভি নামের অ্যাপ নিয়ে তিনি অনুসন্ধানে নামেন। গুগলের তথ্য ঘেঁটে তিনি বের করেন, এটি সিনেমার রেটিং বৃদ্ধি করে টাকা আয়ের সাইটের ডোমেইন। এখানে বিনিয়োগ করার কোনো ব্যাপার নেই। মানুষ এ অ্যাপে টাকা বিনিয়োগ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দেখে তিনি তাঁদের সতর্ক করার জন্য একটি ভিডিও তৈরি করেন। এই অ্যাপ থেকে টাকা উত্তোলন বন্ধ হওয়ার ৫৯ দিন আগেই তিনি ভিডিওটি তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করেছিলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত আগস্টে ‘সিএএফ’ নামের একটি অ্যাপে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। এই অ্যাপ ছিল আন্তদেশীয় ফুটবল খেলা নিয়ে। বিকাশের মাধ্যমে এ অ্যাপে টাকা জমা করার নিয়ম ছিল। এতেও প্রথম দিকে যাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা মুনাফা তুলে নিয়েছিলেন। শেষের দিকে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। চৈতন্যপুর গ্রামে শহিদুল ইসলাম নামের এক যুবক সিএএফ অ্যাপ চালু করেছিলেন বলে অভিযোগ। অবশ্য শহিদুলের দাবি, তিনি ওই অ্যাপ চালুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।
গত বুধবার শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এখন সবার হাতে স্মার্টফোন। নতুন কোনো অ্যাপ এলে কাউকে বলে দিতে হচ্ছে না। সিএএফ বন্ধের পর সিনেমার টিকিট কিনে ডলার আয় করার সুযোগ নিয়ে এসেছিল ই-মুভি অ্যাপ। তিনি জানতে পারেন, ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর মতে, এই অ্যাপগুলো হেরোইনের নেশার মতো। একবার যে করেছে, নতুন অ্যাপ আসার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার সেটাতে বিনিয়োগ করবেই। তাঁকে নিষেধ করলেও শুনবে না। এ ধরনের অ্যাপ আসতেই আছে।
অ্যাপে প্রতারণার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করতে আসেননি বলে জানান রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল হাসান। তিনি বলেন, এই অ্যাপের মালিক কে? কার বিরুদ্ধে দেবে মামলা? মালিককে ধরতে পারলে তো ভালোই হতো।