দূষণে প্রাণ যায় ধলেশ্বরী-বংশীর

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নদী রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ায় এ দুটি নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

সাভারের হেমায়েতপুরে ধলেশ্বরী নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা চামড়াশিল্প নগরের ডাম্পিং ইয়ার্ডে বর্জ্য (চামড়ার উচ্ছিষ্ট অংশ) স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। এই বর্জ্যই নদীর পানিতে গিয়ে পড়ছে। গতকাল সকালেছবি: প্রথম আলো

সাভারের বিভিন্ন স্থান দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশী ও ধলেশ্বরী নদী ভয়াবহ দূষণ আর দখলে স্বকীয়তা হারিয়েছে অনেক আগেই। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই দূষণ-দখল বাড়ছে। এখন দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে নদীগুলোর অনেক স্থানে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক স্থানের পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে।

আজ রোববার বিশ্ব নদী দিবস। নদী রক্ষায় মানুষকে সচেতন করার জন্য নানা দেশে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। এ দিবস সামনে রেখে সাভারের নদীগুলোর খোঁজ নিতে গিয়ে বংশী ও ধলেশ্বরী নদীর এ দুর্দশার চিত্রই উঠে এসেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পানি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত বংশী ও ধলেশ্বরী নদীতে দূষণের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া দূষণে দায়ী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধলেশ্বরী নদী দূষণে ট্যানারির বর্জ্যের দায় অনেক বেশি। দুদিন আগে ঢাকার পরীক্ষাগার থেকে পানি পরীক্ষার একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। যেখানে তিন-চারটি প্যারামিটার এখনো মানমাত্রার বাইরে রয়েছে। এ নদীতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিগ্রামের নিচে থাকার কথা থাকলেও এর বেশি পেয়েছি। পানিতে দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের পরিমাণ (টিডিএস) ১ লিটার পানিতে ২১০০ বা এর নিচে থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ৪ হাজারের ওপরে। বংশী নদী দূষণে দায়ী হিসেবে সম্প্রতি আমরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছি। সেগুলোর বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’

* পরিবেশ অধিদপ্তর পানি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বংশী ও ধলেশ্বরী নদীতে দূষণের প্রমাণ পাচ্ছে। * এ নদীতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলিগ্রামের নিচে থাকার কথা থাকলেও এর বেশি পাওয়া গেছে। * বংশী ও ধলেশ্বরীর দূষণের জন্য মূলত আশুলিয়ার বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও ট্যানারিগুলোকে দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা শিল্পায়ন করেছি, নগরায়ণ করেছি কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলতে পারিনি। এর মধ্যেই তার কুফল ভোগ করছে নদী, দেশের বেশির ভাগ নদী এখন হুমকির সম্মুখীন।’

দূষণের মূল কারণ শিল্পবর্জ্য

বংশী ও ধলেশ্বরী নদী দূষণের জন্য মূলত সাভারের আশুলিয়ায় বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরের ট্যানারিগুলোকে দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল শনিবার বংশী নদীসংলগ্ন ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড) এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পেছনের দিকের বড় বিল বংশীর পানিতে তলিয়ে আছে। নদীর পানি চলে এসেছে ডিইপিজেডের দেয়াল পর্যন্ত। ওই বিলসহ পাশের বংশী নদীতে বিভিন্ন শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য নানাভাবে এসে মিশে যাচ্ছে।

ওই এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে বিলের মধ্য দিয়ে নালা কেটে বিভিন্ন কারখানার কালো পানি বংশী নদীতে ফেলা হয়। এখন তো বিলে বেশি পানি আছে, তাই বোঝা যাচ্ছে না। ওই পানিতে পচা দুর্গন্ধ। বাতাস এলে বাড়ি পর্যন্ত দুর্গন্ধ চলে যায়।

হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়াশিল্প নগর ঘুরে দেখা যায়, ট্যানারি থেকে নালা দিয়ে বর্জ্যমিশ্রিত পানি গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে। আশপাশের কিছু জলজ উদ্ভিদ রাসায়নিকের প্রভাবে বিবর্ণ হয়ে গেছে। নদীর পাড় ঘেঁষে ডাম্পিং ইয়ার্ডে ট্যানারির কঠিন বর্জ্যগুলো (চামড়ার উচ্ছিষ্ট অংশ) স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি হলে এসব বর্জ্যের রাসায়নিক বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে সরাসরি চলে যায় নদীতে।

ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুস সোবহান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে শোধনের পর ইপিজেডের তরল বর্জ্য নিষ্কাশন করা হয়। সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ইপিজেডে আছে মাত্র ৯২টি। যার মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ইটিপি রয়েছে। ল্যাবরেটরিতে নিয়মিত পানি পরীক্ষা করা হয়। ইপিজেড থেকে ক্ষতিকর বর্জ্য বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) দায়িত্বে থাকা ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কঠিন বর্জ্য ও সিইটিপি ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে আমরা তাদের সঙ্গে চুক্তি করব।’

পাল্লা দিয়ে চলছে নদী দখল

সাভার উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের ২০১৯ সালের নদী দখলদারদের তালিকা অনুসারে অবৈধ দখলদারের সংখ্যা ১৩৪। নদীর জায়গা দখল করে তাঁরা গড়ে তুলেছেন আধা পাকা দোকান, বাড়ি, গুদাম, সাভার থানা মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন বহুমুখী সমিতি লিমিটেড, বালুর আড়সহ নানা স্থাপনা।

নদী দখলের বিষয়ে সাভার থানা মুক্তিযোদ্ধা উন্নয়ন বহুমুখী সমিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে এলাকা পর্যন্ত তাঁদের ঘর নির্মাণাধীন, সে পর্যন্ত জায়গাটি খাস। তাঁদের নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন পাঠানো হয়েছে।