মৌলভীবাজারে শুকিয়ে যাচ্ছে বোরো খেত

পানির অভাবে বোরো ধানগাছের গোড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। গত সোমবার বিকেলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বড়কাপন পশ্চিমের মাঠেছবি: প্রথম আলো

যেদিকে চোখ যায়, মাঠজুড়ে সবুজ ধানখেত। বাতাসে দুলছে বোরো ধানের কচি গাছগুলো। এ রকম বেড়ে ওঠা ধানগাছে কৃষকের মন ভরে ওঠার কথা। কিন্তু মন ভালো নেই কৃষকদের। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে। পানির অভাবে বোরো ধানের খেতের মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক জমিরই মাটি শুকিয়ে ফেটে গেছে। দ্রুত পানির ব্যবস্থা করা না গেলে ধানগাছ বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে।

মনু নদ সেচ প্রকল্পের আওতায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের বড়কাপনের পশ্চিমের মাঠে পানির এই সংকট দেখা দিয়েছে। এই মাঠে এলাকার সাত-আটটি গ্রামের মানুষের খেত রয়েছে। প্রকল্পের পানি ছাড়া সেচের আর কোনো বিকল্প নেই কৃষকের কাছে। খেতসংলগ্ন সেচ প্রকল্পের নালায় পানি না থাকার কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে কৃষকেরা পানিপ্রবাহ বাধাহীন করতে গত সোমবার নিজেদের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে সেচ প্রকল্পের নালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন।

পানিসংকটের বিষয়টি আমি জেনেছি। মূল সমস্যা হচ্ছে পানির সোর্স কমে গেছে। ভারতথেকে পানি কম আসছে।
মো. জাবেদ ইকবাল, নির্বাহী প্রকৌশলী, পাউবো

খালগুলো দ্রুত খনন ও পরিষ্কার করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটির মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সভাপতি আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেচের অভাবে বোরো খেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্যানেলগুলো যদি খনন ও পরিষ্কার করা না হয়, তাহলে কৃষকেরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। গত বছর বোরো মৌসুমে পানির সমস্যা হলে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অনেক কৃষক ঋণ করে চাষাবাদ করেছেন। ফসল না হলে তাঁদের ঋণের বোঝা বইতে হবে।’

গত সোমবার বিকেলে সদর উপজেলার মল্লিকসরাই, একাটুনাসহ বড়কাপন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মনু নদ সেচ প্রকল্পের চাঁদনীঘাট এলাকার নালায় পানি আছে। কিন্তু একাটুনা এলাকা থেকে নালার মধ্যে পানিপ্রবাহ নেই। নালার ভাটির দিকে বড়কাপন এলাকা প্রায় পানিশূন্য। নালার মধ্যে কালো কাদামাটি ভেসে আছে। একাটুনা এলাকায় ওই দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত স্থানীয় কৃষকেরা নালার ঘাস ও আগাছা পরিষ্কার করেছেন, যাতে ভাটির দিকে পানি স্বাভাবিক স্রোত যেতে পারে। তারপরও অনেক স্থানে ঘাস-আগাছা রয়ে গেছে। বড়কাপন গ্রামের পশ্চিমের মাঠে সবুজ ধানের মায়া ছড়িয়ে আছে। তবে ওই মাঠের ধানখেতের কাছে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক খেতের জমির মাটি পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক জমিরই উঁচু স্থানগুলো ফেটে গেছে। ছোট-বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। শুকনা মাটিতে ধানের মধ্যে ঘাস গজিয়েছে।

বড়কাপন গ্রামের শিপন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানির অভাবে খেত নষ্ট অই যার (হয়ে যাচ্ছে)। তিন-চাইর (চার) দিনের মধ্যে পানি দিতে না পারলে খেত লাল অই যাইব। ক্যানেল ছাড়া (মনু নদ সেচ প্রকল্পের খাল) সেচ দেওয়ার আর কোনো সুযোগ নাই।’

শিপন জানান, তিনি সাড়ে আট কিয়ার (১ কিয়ার=৩০ শতক) জমিতে বোরো চাষ করেছেন। পানি শুকিয়ে জমিতে ফাটল দিয়েছে। ঘাস হয়ে গেছে। শুকনা থাকায় ঘাস বাছা যাচ্ছে না। প্রতি কিয়ারে হালি, চাষ, রোপণ, শ্রমিকসহ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বোরো খেতে সার ছিটিয়ে ফিরছিলেন বড়কাপন গ্রামের ছাদিকুর রহমান। এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার দুই কিয়ারে পানি নাই। হুকাই (শুকিয়ে গিয়েছে) গেছে। পানি না থাকায় সারও মারা যার না (সার ছিটানো যাচ্ছে না)। ক্যানেলে যে পানি আয় (আসে), তা খেতে আওয়ার (আসার) মতো না। ক্যানেলে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নেই।’

উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পানিসংকটের বিষয়টি আমি জেনেছি। মূল সমস্যা হচ্ছে পানির সোর্স কমে গেছে। ভারত থেকে পানি কম আসছে। এতে মনু নদে পানির ফ্লো কমে গেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মনু ব্যারাজের উজানে দুই-তিন মিটার পানি কমেছে। বাই রোটেশন রুটিন আকারে পানি দিচ্ছি।’