ময়মনসিংহে প্রাথমিক শিক্ষা: নতুন বই পায়নি ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী
ময়মনসিংহে পাঁচ বছর ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কমছে। করোনাভাইরাসের সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকা, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসামুখী হওয়াসহ সামাজিক নানা কারণে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী বাড়েনি। শিশুশিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে বছরের প্রথম দিনে তাদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু এবার শুরুতে সেটাও সম্ভব হয়নি। ময়মনসিংহের ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিন নতুন বই পায়নি। এতে নতুন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শিক্ষা বিভাগ বলছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বাড়াতে তারা নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে। বিদ্যালয়ের অনিয়ম দূর করার পাশাপাশি শিক্ষকদের হোম ভিজিট, মা সমাবেশ ও উঠান বৈঠকে গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন বইয়ের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, নানা সীমাবদ্ধতায় এবার নতুন বই কম এসেছে। তবে ২০ জানুয়ারির মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এর আগে শিক্ষকদের তারুণ্যের উৎসবসহ অনলাইনের বই দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের ১৩টি উপজেলায় মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ২ হাজার ১৪০টি। এসব বিদ্যালয়ে ২০১৯ সালে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল ১০ লাখ ১৫ হাজার ৪৬৭ জন। ২০২৪ সালে সেটি কমে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৪৩ হাজার ১৬৬ জনে। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে ২ লাখ ৭২ হাজার ৩০১ জন। এ ছাড়া ২০২০ সালে ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৪২৪ জন, ২০২১ সালে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯৮, ২০২২ সালে ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯৬, ২০২৩ সালে ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৪২০ ও ২০২৪ সালে ৭ লাখ ৪৩ হাজার ১৬৬ জন। তবে বাস্তবে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার সংখ্যা আরও বেশি।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের শুরুর দিকে করোনা মহামারির কারণে বিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় সরকার। এরপর দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হয়নি। এ সময় বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) পরিচালিত স্কুল ও অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অভিভাবকদের অনেকে সন্তানকে ওই সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। এতে নতুন শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়মুখী করা যায়নি। এর বাইরে প্রাথমিকে ‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্প বন্ধ হওয়া, বিদ্যালয়ে শিক্ষকসংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা ছিল।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলার ২ হাজার ১৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১০৬টিতে প্রধান শিক্ষক নেই। ১১ হাজার ৯০৫ সহকারী প্রধান শিক্ষকের মধ্যে নেই ৬০৮ জন। প্রাথমিক বিদ্যালয় তদারকির জন্য ৮৭ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও সংকট আছে ২২ জনের।
জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের বাঘবেড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০২৪ সালে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিল ১২৩ জন। অথচ ২০১৯ সালে শিক্ষার্থী ছিল ১৮৫ জন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিদ্যালয়টিতে এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী কমেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মহামারির সময় থেকে এলাকায় মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশুরা মাদ্রাসামুখী হয়েছে। এ ছাড়া ‘স্কুল ফিডিং’ বন্ধ থাকা ও গ্রামে শিশুর জন্মহার কমে যাওয়াও একটি কারণ। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ছেলেশিক্ষার্থীর চেয়ে বিদ্যালয়ে মেয়েশিক্ষার্থী বেশি। ছেলেদের বেশির ভাগ মাদ্রাসায় যাচ্ছে। আমরা নিয়মিত হোম ভিজিট করে শিক্ষার্থী বাড়ানোর জন্য কাজ করছি, কিন্তু ফল মিলছে না। এবার বছরের শুরুতে প্রাক্-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির নতুন বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থী ভর্তিতে ধাক্কা লাগতে পারে।’
ত্রিশাল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমতে থাকায় গত বছর থেকে তাঁরা মাঠপর্যায়ে জোরেশোরে কাজ শুরু করেন। শিক্ষকদের হোম ভিজিট, মা সমাবেশ ও উঠান বৈঠকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। পাশাপাশি নিজেরাও কঠোরভাবে তদারকি করছেন।
বই পায়নি ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী
শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় সরকারি, বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বইয়ের চাহিদা ছিল ৩৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩৯২টি। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বই পাওয়া গেছে ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪২০টি, যা মোট চাহিদার ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ। বছরের প্রথম দিন ১৩টি উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলায় প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ এবং ভালুকা, গফরগাঁও ও ধোবাউড়া উপজেলায় আংশিক বই পাওয়া গেছে। প্রাক্-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনো বই আজ বুধবার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ত্রিশালের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিক বলেন, উপজেলায় ৩ লাখ ২২ হাজার ৫০০টি বইয়ের চাহিদা থাকলেও ১ লাখ ১৪ হাজার বই পাওয়া গেছে। প্রথম শ্রেণির দুটি, দ্বিতীয় শ্রেণির পুরো সেট ও তৃতীয় শ্রেণির তিনটি বই পাওয়া গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন বই দিতে না পারলেও তারুণ্যের উৎসবসহ নানা কার্যক্রম দিয়ে স্কুলগুলো পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুরুতে নতুন বই না পেলেও শিক্ষার্থী কমবে না বলে তিনি মনে করেন।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কমার পেছনে অনেক কারণ আছে। সামাজিক কারণ ও ধর্মীয় আনুগত্যের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতাও থাকতে পারে। তাঁরা সব বিষয় মাথায় রেখে ভালো করার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে কোনো প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম থাকলে ব্যবস্থা নেবেন। শিক্ষার্থী বাড়াতে গুরুত্ব বুঝে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থী ঝরে পড়া তো দূরের কথা, আরও কীভাবে ভালো করা যায়, সেটিই আমাদের টার্গেট। গত রাতেও সব শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে জুম মিটিং করেছি। বাংলা হাতের লেখা সুন্দর করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালু করতে বলা হয়েছে।’
আজ ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে নতুন বই বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। চাহিদার তুলনায় বই কম পেয়েছি। আশা করছি, ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারব। অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতি অনুরোধ, বইয়ের অজুহাতে যেন পাঠ কার্যক্রম থেকে কেউ বিরত না থাকে।’