মংডু-টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে গত সোমবার পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। আকিয়াব থেকেও আগের মতো পণ্য আসছে না।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গোলাগুলি ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সীমান্তে সতর্ক প্রহরা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সংঘর্ষ। শুরুর দিকে এ সংঘর্ষের ক্ষেত্র ছিল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে কয়েকটি পাহাড়। তবে ক্রমে সংঘর্ষের ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে।

এ অবস্থায় গত সোমবার থেকে রাখাইনের জেলা শহর মংডু থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আসা বন্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে এপার থেকেও কোনো পণ্য যাচ্ছে না ওই শহরে।

মংডুর অবস্থান টেকনাফের উল্টো পাশে নাফ নদীর ওপারে। টেকনাফ স্থলবন্দর থেকে শহরটির দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার।

টেকনাফ-মংডু সীমান্ত বাণিজ্য অচল হয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন ৪০০ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের বিভাগীয় বন্দরনগর আকিয়াব (সিথুয়ে) থেকে পণ্য আনতে হচ্ছে তাঁদের। এতে ব্যয় বেড়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আকিয়াব–টেকনাফ পথেও পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ট্রলারে করে মংডু থেকে নারকেল, পেঁয়াজ, আদা, আচার ইত্যাদি পণ্য আসত টেকনাফ স্থলবন্দরে। ছয় দিন ধরে তা বন্ধ রয়েছে। আবার আকিয়াব থেকেও আগের মতো পণ্য আসছে না। স্বাভাবিক সময়ে সেখান থেকে ১০–১২টি ট্রলারে নানা ধরনের পণ্য আসত টেকনাফ স্থলবন্দরে। গতকাল শনিবার এসেছে মাত্র তিনটি ট্রলার। এর আগের দিন শুক্রবার এ সংখ্যা ছিল চার।

টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংঘর্ষের কারণে মংডুর পরিস্থিতি থমথমে। ফলে সেখান থেকে ট্রলারে করে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না।

তবে বন্দরনগর আকিয়াব থেকে কিছু ট্রলার বঙ্গোপসাগর হয়ে সেন্ট মার্টিনের জলসীমানা দিয়ে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসছে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

‘আমদানি-রপ্তানিতে অঘোষিত বিধিনিষেধ’

শুল্ক বিভাগ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্যমতে, সীমান্ত চোরাচালান নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের টেকনাফ ও মিয়ানমারের মংডুর সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য চালু করেছিল।

মিয়ানমারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বন্দরে আমদানি পণ্যে ভাটা পড়েছে উল্লেখ করে টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মো. লুৎফুল হক বলেন, এতে করে রাজস্ব আদায়ও কমছে।

গতকাল শনিবার সকালে বন্দরে গিয়ে দেখা যায়, একটি ট্রলার থেকে হিমায়িত মাছের কার্টুন খালাস করছেন শ্রমিকেরা। ট্রলারটিতে ৪০ টন রুই, কাতলা মাছ আছে বলে জানান আমদানিকারক ও টেকনাফের ব্যবসায়ী এম কায়সার।

স্থলবন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা রাখাইন রাজ্যের কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, মংডু শহরে ১০ থেকে ১২ দিন ধরে কড়াকড়ি চলছে। হাটবাজারে লোকসমাগম করতে দেওয়া হচ্ছে না। বিকেল চারটার পর দোকানপাট বন্ধ রাখা হচ্ছে। সড়কে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী।

মংডু থেকে উত্তর দিকে তুমব্রুরাইট পর্যন্ত (এপারে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম) ৩৭ কিলোমিটারের মংডু-ঢেকুবনিয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ আছে। সড়কের পূর্ব পাশের বিভিন্ন পাহাড়ে আরাকান আর্মিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ঘাঁটি গেড়ে মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্তচৌকিকে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে।

ওই ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, গোলাগুলির কারণে টেকনাফ বন্দরে পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। আমদানি-রপ্তানিতে অঘোষিত বিধিনিষেধ চলছে। আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুন থেকেও মংডুতে পণ্যসামগ্রী আনা যাচ্ছে না।

‘বর্ডার পাস’ বন্ধ ছয় বছর

শুল্ক ও বিজিবি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাখাইন রাজ্যের তিনটি সীমান্ত ছাউনিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সীমান্ত বাণিজ্যের ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের তিন দিনের বর্ডার পাস (সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি) এবং দুই পারের (টেকনাফ ও মংডু) লোকজনের যাতায়াতের এক দিনের ট্রানজিট পাস বন্ধ করে দেয়। নানা অজুহাতে সেটা আর চালু করা হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে বাণিজ্য চালুর শুরু থেকেই চলছে ঘাটতির বাণিজ্য চলে আসছে।

স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়েছে ১১৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দামের ১ কোটি ৪৮ লাখ কেজি ওজনের পণ্য। আর একই সময় বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা দামের ৭৬ হাজার কেজি ওজনের আলু ও গার্মেন্টস পণ্য।

স্থলবন্দরের পরিচালন সংস্থা ইউনাইটেড ল্যান্ডপোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এখন মিয়ানমারের আকিয়াব থেকে আমদানি করা হচ্ছে কাঠ, হিমায়িত মাছ, সুপারি, আচার, নারকেল, আদাসহ বিভিন্ন পণ্য। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে আলু, গার্মেন্টস পণ্য, মানুষের মাথার চুল ও চিপস।

টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বলেন, রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের বিশাল বাজার রয়েছে। কিন্তু বর্ডার পাস বন্ধ থাকায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা সেখানে গিয়ে বাজার তৈরি করতে পারছেন না। ফলে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি কমে আসছে। বাড়ছে ঘাটতির বাণিজ্য।

টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ বন্ধ

বান্দরবানের ঘুমধুম এবং কক্সবাজারের হোয়াইক্যং ও পালংখালী সীমান্তের মানুষ গতকাল গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায়নি। তবে ওপারে মংডু ও তার পাশের বুচিডং শহরে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। একাধিক সূত্রমতে, গত কয়েক দিনের সহিংসতায় বুচিডং শহরের তিনটি গ্রামের অন্তত ৮০০ পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

এদিকে রাখাইনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জেরে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। জাহাজমালিকদের সংগঠন সি ক্রজ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের (স্কোয়াচ) সভাপতি তোফায়েল আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নাফ নদী দুই দেশের সীমারেখা ভাগ করে দিয়েছে। নাফ নদী হয়েই পর্যটকবাহী জাহাজগুলো সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত করে।

তা ছাড়া নাফ নদীর বদরমোকামসহ বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক ডুবোচর জেগে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে জাহাজ চলাচল উচিত হবে না। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টেকনাফের পরিবর্তে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ সরাসরি সেন্ট মার্টিনে যাতায়াত করবে।

তবে মিয়ানমার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী ১ নভেম্বর থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল শুরু হবে। আগে এ নৌপথে চলাচল করত ১০টি প্রমোদতরি।