চট্টগ্রামের মিরসরাই
টোপাপানায় ম্লান মহামায়া হ্রদের আকর্ষণ
মহামায়া হ্রদের বড় অংশজুড়ে এখন চোখে পড়ে টোপাপানার চাদর আর চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা। বাঁধের কিনারজুড়ে ঘাস আর লতাগুল্মের ঝোপ। হ্রদে ইঞ্জিনচালিত নৌকার দৌরাত্ম্য। টিকিটেও আদায় হচ্ছে বাড়তি টাকা।
মূল ফটক পেরোলেই সমান্তরাল পিচঢালা রাস্তা। পূর্ব দিকে সেটি উঠে গেছে মহামায়া হ্রদের বাঁধ পর্যন্ত। খাড়া পথ বেয়ে ওঠা ক্লান্ত পর্যটকদের মনে একসময় প্রশান্তি এনে দিত পাহাড়ঘেরা বিস্তীর্ণ মহামায়া হ্রদের টলটলে জলরাশি। মায়াবী সে দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না।
মহামায়া হ্রদের বড় অংশজুড়ে এখন চোখে পড়ে টোপাপানার চাদর আর চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা। বাঁধের কিনারজুড়ে ঘাস ও লতাগুল্মের ঝোপ। হ্রদে ইঞ্জিনচালিত নৌকার দৌরাত্ম্য। টিকিটেও আদায় হচ্ছে বাড়তি টাকা। সব মিলিয়ে মহামায়া ইকোপার্ক এলাকায় বেড়াতে আসা পর্যটকেরা হতাশ। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় দেশের পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় এ স্থান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পর্যটকেরা।
মহামায়া হ্রদ ও ইকোপার্কের অবস্থান মিরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নে। সেচ সম্প্রসারণের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে মহামায়া ছড়ার ওপর বাঁধ দিলে পাহাড়ের কোলজুড়ে ১১ বর্গকিলোমিটারের মহামায়া হ্রদ তৈরি হয়। পরে বন বিভাগ এখানকার ১ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমি নিয়ে তৈরি করে মহামায়া ইকোপার্ক। ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। গত ২২ জুলাই থেকে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ২ কোটি ২৫ লাখ ৫৬ হাজার ২৫০ টাকায় ১ বছরের জন্য মহামায়া ইকোপার্কের ইজারা পেয়েছে ওয়াসিফা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মহামায়া হ্রদ ও ইকোপার্ক ঘুরে দেখা যায়, শ খানেক পর্যটক বেড়াতে এসেছেন। একদল তরুণ হ্রদের বাঁধে বসে গান করছেন। আশপাশের বেঞ্চে বসে গল্পে মেতেছেন কেউ কেউ। হ্রদের পাড়ে বাঁধা সারি সারি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আর কায়াক। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে হ্রদ ঘুরে দেখতে বেরিয়েছে দুটি দল। দুটি দলের কোনো সদস্যকেই দেখা গেল না লাইফজ্যাকেট পরতে। কিছুদূর যেতেই ইঞ্জিনচালিত নৌকার বিকট শব্দে উড়ে যেতে দেখা গেল একদল পানকৌড়িকে। হ্রদের বড় একটি অংশজুড়ে টোপাপানার ভারী আস্তরণ।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ মহামায়ার আয়তন প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা স্বচ্ছ জলের এই হ্রদের এখন ৩ থেকে ৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা টোপাপানায় ভরে গেছে। দ্রুত বেড়ে চলা এসব জলজ আগাছা মাছের বিচরণক্ষেত্র নষ্টসহ হ্রদের বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সংকুচিত হচ্ছে পর্যটকদের ভ্রমণ এলাকা।
ইজারাদারের নিয়োগ করা কয়েকজন শ্রমিক নৌকা নিয়ে এক পাশে পরিষ্কার করছিলেন সেসব টোপাপানা। বাঁধের পূর্ব পাশজুড়েই ঘাস ও লতাগুল্মের জঙ্গল। ঘাস মারার ওষুধ ছিটিয়ে বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলো। এসব দৃশ্য হ্রদ দেখে প্রশান্তি পাওয়ার বদলে বিষণ্ন করে তুলবে যেকোনো পর্যটকের মন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ মহামায়ার আয়তন প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা স্বচ্ছ জলের এই হ্রদের এখন ৩ থেকে ৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা টোপাপানায় ভরে গেছে। দ্রুত বেড়ে চলা এসব জলজ আগাছা মাছের বিচরণক্ষেত্র নষ্টসহ হ্রদের বাস্তুসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সংকুচিত হচ্ছে পর্যটকদের ভ্রমণ এলাকা।
নৌকা–বিড়ম্বনা
ইকোপার্ক হওয়ার শর্তে সংরক্ষিত এলাকার প্রাণপ্রকৃতির ক্ষতি না করে বিনোদন ও প্রকৃতি থেকে শিক্ষার কথা বলা হলেও মহামায়া ইকোপার্কের চিত্র যেন পুরোই ভিন্ন। বন বিভাগের ইজারার শর্তে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানো নিষিদ্ধ হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেনে চলছে না সে নিয়ম। বরং কোনো প্রকার নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া চলা এসব ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পর্যটকদের কাছ থেকে আদায় করা হয় বাড়তি ভাড়া।
নৌকার মালিক ও চালকেরা জানান, পর্যটকদের কাছ থেকে আদায় করা ভাড়ার একটি অংশ পান ইজারাদার। বৃহস্পতিবার দুপুরে মহামায়া হ্রদের অন্তত ৬৮টি নৌকা ও অর্ধশত কায়াক দেখা যায়। এসব নৌকার মধ্যে ছোট–বড় ৪২টি ইঞ্জিনচালিত। এমনই একটি নৌকার চালক মো. আজিম উদ্দিন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় নৌকায় পুরো হ্রদ ঘুরে দেখতে চাইলে পর্যটকদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। আর ঝরনা এলাকায় গেলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ছোট নৌকায় তা ১ হাজার ৫০০ ও ১ হাজার। প্রতি ট্রিপে বড় নৌকা থেকে ইজারাদার পান ৬০০ টাকা, ছোট নৌকা থেকে ৪০০ টাকা। তবে পর্যটন মৌসুম ছাড়া অন্য সময় তেমন বেশি যাত্রী হয় না এসব নৌকায়।
টিকিটে বাড়তি টাকা
ইজারার শর্তে টিকিটপ্রতি ২০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও নিয়ম অমান্য করে পর্যটকদের কাছ থেকে ৩০ টাকা আদায় করেন ইজারাদার। ইকোপার্ক এলাকায় কথা হয় চট্টগ্রামের হালিশহর থেকে বেড়াতে আসা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাওসিফ মারুফের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা আট বন্ধু মহামায়া ইকোপার্ক ও হ্রদ দেখতে এসেছি। মূল ফটকের টিকিট কাউন্টারে আমাদের কাছ থেকে টিকিটপ্রতি ৩০ টাকা আদায় করেছে। টিকিটের গায়ে বা কোথাও দাম লেখা না থাকায় প্রকৃত মূল্য কত, তা আমরা জানতে পারিনি।’
হ্রদজুড়ে টোপাপানার বিস্তার, পানির কালচে রং আর বাঁধের ধার ঘেঁষে ঝোপ এখানকার সৌন্দর্য একেবারে ম্লান করে দিয়েছে। দ্রুতই হ্রদটি নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।মো. ফরিদুল করিম, পর্যটক
মহামায়া হ্রদে সপরিবার ঘুরতে আসেন ঢাকার কাঁটাবন এলাকার মো. ফরিদুল করিম। এই পর্যটক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর আগে একবার সহকর্মীদের সঙ্গে মহামায়া হ্রদ ঘুরে গিয়েছিলাম। হ্রদে চমৎকার স্বচ্ছ টলটলে জলের মায়া, চারদিকে সবুজ পাহাড়ের হাতছানি, পাখিদের ওড়াউড়ির মনোরম দৃশ্য আবারও আসতে প্ররোচিত করেছে আমাকে। কিন্তু হ্রদের এখনকার পরিবেশ হতাশ করেছে আমাদের।’ তিনি আরও বলেন, ‘হ্রদজুড়ে টোপাপানার বিস্তার, পানির কালচে রং আর বাঁধের ধার ঘেঁষে ঝোপ এখানকার সৌন্দর্য একেবারে ম্লান করে দিয়েছে। দ্রুতই হ্রদটি নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’
হ্রদের এমন দুরবস্থা ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ইজারাদারের পক্ষে মহামায়া ইকোপার্কের ব্যবস্থাপক তছলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামায়া হ্রদের বড় একটি অংশজুড়ে টোপাপানার বিস্তার ঘটায় এখানে পর্যটন ব্যাহত হচ্ছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের বারবার বলেও এ বিষয়ে কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। এখন ব্যবসার স্বার্থে নিজেদের পয়সা খরচ করে হ্রদের কিছু অংশ পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।’
তছলিম উদ্দিন আরও বলেন, ‘হ্রদের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে পানা অপসারণে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এখানে পর্যটন মুখ থুবড়ে পড়বে। আর হ্রদে নৌকা চালানোর বিষয়টিতে স্থানীয় মানুষদের জীবন–জীবিকা জড়িত থাকায় স্বল্প পরিসরে তা চালু আছে। লাইফজ্যাকেট পরার বিষয়ে পর্যটকদের আগ্রহ কম। আমরাও কিছুটা উদাসীন, সেটি সত্য। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’
টিকিটে বাড়তি টাকা রাখার বিষয়টিও স্বীকার করেন তছলিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ইজারামূল্য বেশি হওয়ায় খরচ তুলে আনতে মাঝেমধ্যে এটি আমাদের করতে হয়। বিনিয়োগ ও পরিচালনা ব্যয়ের তুলনায় টিকিটের মূল্য মাত্র ২০ টাকা, যা অতি নগণ্য। আমাদের অনুরোধ থাকবে টিকিটের মূল্য বাড়ানোসহ ইজারামূল্যের একটি অংশ যেন ইকোপার্কের উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহামায়া ইকোপার্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের মিরসরাই রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামায়া হ্রদে টোপাপানার বিস্তার এখানকার পর্যটন ও প্রাণপ্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরাদ্দ না থাকায় পানা অপসারণের ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে লিখে জানিয়েছি আমরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘হ্রদে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানোর কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে ইজারাদারদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। আর টিকিটে বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ পেলে ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’