বগুড়ায় বিদ্যুতের লাইন টানতে তালগাছ ন্যাড়া 

  • সরকার যখন বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে তালগাছ রোপণ করছে, সে সময় তালগাছ কেটে নষ্ট করা চরম অপরাধ।

  • ৪০টির মধ্যে ৭টি গাছ ইতিমধ্যে মরে গেছে। বিদ্যুতের পাঁচ-ছয়টি খুঁটি সরিয়ে দিলে এখনো হয়তো কিছু তালগাছ বাঁচবে।

পল্লী বিদ্যুতের লাইন টানতে তালগাছের ডগা কেটে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি গাছ মারাও গেছে। মঙ্গলবার বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নে রেললাইনের পাশে
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার আদমদীঘিতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন টানতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রোপণ করা তালগাছ মেরে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের রেললাইনের পাশে বেড়ে ওঠা ৪০টি তালগাছের ৭টি ইতিমধ্যে মরে গেছে। ডাল কেটে ফেলার কারণে বাকিগুলোও ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাসিন্দারা। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বলছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এবং দুর্ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য তালগাছের ডাল কেটে দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাসিন্দারা। 

উপজেলার নশরতপুর রেলস্টেশনের উত্তর পাশে তালগাছগুলোর অবস্থান। গত মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে একদল বীর মুক্তিযোদ্ধা বিজয়ের নিদর্শন হিসেবে তালগাছগুলো রোপণ করেন। এই দলে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নশরতপুর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ত ম শামছুল হক, মুনছুর রহমান, আবুল কাশেম, জাহাঙ্গীর আলম, নজরুল ইসলাম, শাহাদত হোসেন, সুনীল কুমার সরকারসহ অনেকে।

কয়েজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, প্রয়াত শামছুল হকের ইচ্ছা ছিল, তাঁদের লাগানো তালগাছের মধ্যে ৭১টি তালগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার পরের বছর ১৬ ডিসেম্বর শতাধিক তালের বীজ রোপণ করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭৫টি তালগাছ টিকে থাকে। এরপর কিছু মরে গেলেও সর্বশেষ ৪০টি তালগাছ বেড়ে ওঠে। শামছুল হকসহ অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করলেও তাঁদের লাগানো গাছগুলো স্মৃতি বহন করছিল।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের দিকে আদমদীঘির মুরইল বাজার এলাকায় একটি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হয়। এখান থেকে নশরতপুর এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন টানার সময় গত এপ্রিলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি পর্যায়ক্রমে ওই তালগাছগুলোর ডাল কাটতে শুরু করে।

স্বাধীনতা ও বিজয়ের জীবন্ত স্মারক হিসেবে তালগাছগুলো রোপণ করা হয়েছিল। পল্লী বিদ্যুতের লোকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত তালগাছগুলো নির্বিচার কেটে ফেলে চরম অন্যায় করেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ও সুনীল কুমার সরকার 

বহুবার বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাধা দিলেও কেউ কর্ণপাত করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক ও সুনীল কুমার সরকার বলেন, স্বাধীনতা ও বিজয়ের জীবন্ত স্মারক হিসেবে তালগাছগুলো রোপণ করা হয়েছিল। পল্লী বিদ্যুতের লোকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত তালগাছগুলো নির্বিচার কেটে ফেলে চরম অন্যায় করেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ বলেন, সরকার যখন বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তালগাছ রোপণ করছে, সে সময় তালগাছ কেটে নষ্ট করা চরম অপরাধ। এ ছাড়া এ গাছগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লাগানো, বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।

নশরতপুর স্টেশনের পাশের ধনতলা গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম এসব গাছ রোপণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘একের পর এক গাছ মরে যাওয়ায় আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের ছেলে মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘বাবা আমাকে বলেছিলেন, তিনি বিভিন্ন গ্রাম থেকে তালবীজগুলো সংগ্রহ করেছিলেন।’ তালগাছের ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের পাঁচ-ছয়টি খুঁটি সরিয়ে দিলে এখনো হয়তো কিছু তালগাছ বাঁচানো যেতে পারে বলে জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজার রহমান।

গাছ না কেটে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা যেত কি না, জানতে চাইলে দুপচাঁচিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালগাছের বিষয়টি আমি জেনেছি। দ্রুত আমি ওই এলাকায় যাব এবং বিষয়টি তদন্ত করব। কারণ, গাছ মেরে ফেলার বিষয়টি আমাকেও খুব ব্যথিত করেছে।’