‘সংকেত শুনলি পরানডা কাঁইপে ওঠে’
‘শুনলাম আবার নাকি হামুন নামের এক ঝড় আসপে। এলাকার মেম্বার (ইউপি সদস্য) কয়ে গেল সাবধান থাকতি হবে। আমাগের আর সাবধানের কী আছে। ঝড় আসলি আর নদীর পানি বাড়লি তো বেড়িবাঁধ ভাঙবে, আর বাঁধ ভাঙলি তো ঘর সরাতি হবে। ঘর ভাঙলি যে কত কষ্ট, তা বুঝবে কিডা। প্রত্যেক বছর ভয়ে থাকি—এই বুঝি সংকেত আসল। সংকেত শুনলি পরানডা কাঁইপে ওঠে।’
ঘূর্ণিঝড় হামুনের আগাম সতর্কসংকেত শুনে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার হাজতখালী গ্রামের কার্তিক মন্ডল। গত চার বছরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসে দুবার তাঁর ঘর ভেঙেছে। অনেক কষ্টে তা সামাল দিয়ে নতুন করে ঘর তুলে বাঁধের পাশে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। আবারও ঝড়ের সংকেত শুনে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
কপোতাক্ষ নদ–তীরবর্তী মদিনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা নিরঞ্জন মন্ডলসহ অনেকেই আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে তাঁদের বাড়িঘর রশি বেঁধে মজবুত করার চেষ্টা করছিলেন। নিরঞ্জন মন্ডল জানান, আগে ভরা জোয়ারে বাড়ির সামনের বাঁধের অর্ধেক পর্যন্ত পানি থাকত। এখন বাঁধ কানায় কানায় পূর্ণ হয়। বাঁধ ছাপিয়ে লোকালয় লোনাপানিতে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কায় কয়েক মাস আগে বাঁধের ওপর মাটির দেয়াল দেওয়া হয়েছিল। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সেখানে পরিদর্শন করে বাঁধ উঁচু করে মেরামতের আশ্বাস দেন। কিন্তু সেখানে আর কাজ হয়নি। এবার আরও ঝুঁকিতে রয়েছে বাঁধটি।
শুধু কার্তিক মন্ডল আর নিরঞ্জন মন্ডলই নন; তাঁদের মতোই উপকূলীয় উপজেলা কয়রার অসংখ্য মানুষ ঘূর্ণিঝড় হামুন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বিশেষ করে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়েই তাঁদের উৎকণ্ঠা বেশি। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় হামুন আতঙ্কে সুন্দরবনে মাছ শিকার করতে যাওয়া কয়রার জেলেরা ইতিমধ্যে মাছ শিকার না করে নৌকা নিয়ে উপকূলে ফিরতে শুরু করেছেন। ফিরে আসা জেলেরা বলছেন, বনের পাশে বঙ্গোপসাগর ভয়ংকর রকম উত্তাল হয়ে ওঠায় উপকূলে ফিরে এসেছেন তাঁরা।
মহারাজপুর এলাকার জেলে আবু মুসা বলেন, তাঁরা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ছিলেন। তবে জঙ্গলের নদীতে এখন অনেক ঢেউ, পানিও বেড়ে গেছে। এ জন্য আগাম আবহাওয়ার খবর পেয়ে উপকূলে ফিরে এসেছেন। যাঁরা এখনো বনে আছেন, তাঁদের কাছে ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা পৌঁছালে তাঁরাও চলে আসবেন বলে তিনি জানান।
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় হামুনের জন্য বন বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তাঁদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারসহ শুকনা খাবার মজুতের জন্য প্রতিটি টহল ফাঁড়ি ও অফিসকে বলা হয়েছে।
কয়রা উপজেলার জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসী ও পাউবোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে উপজেলার মদীনাবাদ লঞ্চঘাট–সংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়ি, মহেশ্বরীপুর, কাটকাটা, গাতিরঘেরি, জোড়শিং, গোলখালীসহ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধের প্রায় পাঁচ কিলোমিটারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এ ছাড়া উপজেলার ৪ নম্বর কয়রা, ৬ নম্বর কয়রা, নয়ানী, পাথরখালী, জোড়শিং এলাকাসহ প্রায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধজুড়ে মাটির দেয়াল তুলে জোয়ার ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
কয়রা উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, অন্যান্য দুর্যোগের মতো এবারও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকাবাসীকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। নদীতীরে দেখা যায়, সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা মাছ ধরার সারি সারি নৌকা ভিড়ে আছে।
তবে উপজেলার কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদী-তীরবর্তী যেসব এলাকায় এখনো মজবুত বেড়িবাঁধ হয়নি, সেসব গ্রামে বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে হামুন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি দেখা দিয়েছে। তাঁদের অধিকাংশেরই নেই দুর্যোগ–সহনীয় বাড়িঘর। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের অনেকেই এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। এর মধ্যে আরেকটি দুর্যোগের সতর্কসংকেত তাঁদের ভাবিয়ে তুলেছে।
পাউবো সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর উপজেলার ২১টি জায়গায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হয়। পাশাপাশি ২০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে সংস্কার করা হয়। বর্তমানে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে মজবুত বাঁধের কাজসহ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সংস্কারকাজ চলমান রয়েছে। তবে এখনো কিছু এলাকায় বাঁধ ঝুঁকিতে আছে। খুলনা পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মুহম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘এ মুহূর্তে বাঁধের দুর্বল অংশে মেরামতকাজ চলমান রয়েছে। তা ছাড়া দুর্যোগে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।’
কয়রা আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাসানুল বান্না প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ অক্টোবর ভোরের দিকে উপকূল অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। সুন্দরবন উপকূলে ভারী বৃষ্টিও হতে পারে। নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুট উঁচু জোয়ার হওয়ার আশঙ্কা আছে। কয়রা উপকূলীয় উপজেলা ৫ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।
সার্বিক বিষয়ে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মমিনুর রহমান জানান, সতর্কতামূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা, দুর্যোগকালীন ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য, পানীয়ের ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা হয়েছে। সুন্দরবনে অবস্থানরত জেলেরাও যেন নিরাপদে তীরে ফিরে আসেন, সে জন্য মৎস্যজীবী সমিতির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে।