লোকসানে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চালকল

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায় সান্তাহার সাইলো সড়ক–সংলগ্ন এলাকায় বন্ধ হয়ে যাওয়া মতি চালকলছবি: প্রথম আলো

টানা লোকসানে ব্যবসার মূলধন হারানোয় বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ২৩৩টি চালকল (হাসকিং মিল) বন্ধ হয়ে গেছে। চালকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে তাঁরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ২৯৮টি চালকল ছিল। এর মধ্যে সাধারণ চালকল ২৮৪টি এবং স্বয়ংক্রিয় চালকল ১৪টি। চুক্তি ভঙ্গ করায় এর মধ্যে ৫২টি সাধারণ চালকল এবং ৩টি স্বয়ংক্রিয় চালকলের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমানে ১১টি স্বয়ংক্রিয় ও ৫৪টি সাধারণ চালকল চালু রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে উপজেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার সাত শ মেট্রিক টন। সংগৃহীত চালের মধ্যে প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন সরবরাহ করেছে স্বয়ংক্রিয় চালকল, বাকি সাত শ মেট্রিক টন সরবরাহ করেছে সাধারণ চালকল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় খাদ্যগুদাম (সান্তাহার সিএসডি ও সাইলো) আদমদীঘি উপজেলায়। এ ছাড়া এই উপজেলায় প্রচুর ধান উৎপাদিত হয়। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো চালকল গড়ে ওঠে। অনেকে ফসলের জমিতেই চালকল স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম প্রথম ব্যবসায় ভালো মুনাফা হয়। ২০০৪ সালে এই উপজেলায় স্বয়ংক্রিয় চালকল চালু হওয়ার আগপর্যন্ত সাধারণ চালকলের ব্যবসা লাভজনক ছিল। কিন্তু ধান সেদ্ধ ও শুকানো ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় চালকলে সরাসরি কাঁচা ধান থেকে দ্রুত চাল বের হয়। এতে স্বয়ংক্রিয় চালকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকসানে পড়ে একের পর এক সাধারণ চালকল বন্ধ হতে থাকে।

সান্তাহার শহরের মুসফিক চালকলের মালিক মতিয়ুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, তাঁর একটি সাধারণ চালকলে ১৫ দিনে ধান ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা ১৫৪ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ধানের প্রয়োজন হয় ১৪০ বস্তা (প্রতি বস্তা ৭৫ কেজি)। কিন্তু শহরের বৈশাখী নামের স্বয়ংক্রিয় চালকলে ১৫ দিনে ৩টি ইউনিটের ছাঁটাইয়ের ক্ষমতা ৪৮ হাজার মেট্রিক টন। প্রতিদিন এই চালকলে ধানের প্রয়োজন হয় তিন হাজার মেট্রিক টনের বেশি। উৎপাদন ক্ষমতার বিশাল ব্যবধান হওয়ায় এবং লাভ কম হওয়ায় সাধারণ চালকলগুলো ২৩ বছরে বন্ধ হয়ে যায়।

সাধারণ চালকলের মালিক হেলালুর রহমান বলেন, ‘নানা কারণে স্বয়ংক্রিয় চালকল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা টিকতে পারছি না। অন্যতম কারণ হলো ধান থেকে চাল উৎপাদনের আনুপাতিক হার। সাধারণ চালকলে প্রতি মণে ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয় ২৫ কেজি, অথচ স্বয়ংক্রিয় চালকলে প্রতি মণে উৎপন্ন হয় প্রায় ২৮ কেজি। সাধারণ চালকলে ধান থেকে ১২–১৫ কেজি তুষ উৎপাদন হয়, যার দাম অনেক কম। পক্ষান্তরে স্বয়ংক্রিয় চালকলে ছয় শ মণ ধান থেকে চালের কুড়া বের হয় প্রায় ৪০ বস্তা। প্রতি ৫০ কেজি ওজনের বস্তার মূল্য প্রায় দুই হাজার টাকা। চালের কুড়া থেকে ভোজ্যতেল, মাছসহ পশুখাদ্য তৈরি হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অনেক বেশি। এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় চালকলের মালিকেরা স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়ায় ধান কাটার পরপরই বেশি করে ধান কিনে রাখতে পারেন, যেটি সাধারণ চালকলের মালিকেরা পারেন না।’

চাল ব্যবসায়ী মতিয়ুর রহমান বলেন, বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় চাল তৈরি করে লাভ হচ্ছে না। প্রতি মণ ধান কেনাসহ উৎপাদন খরচ পড়ছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ টাকায়। প্রতি মণে লোকসান হচ্ছে দেড় থেকে দুই শ টাকা।

মতিয়ুর রহমান জানান, দুই শর বেশি চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছেন। এসব শ্রমিক বর্তমানে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

মতি চালকলের নারী শ্রমিক রেহেনা বেগম, মর্জিনা বেগম, আনিসুর ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, ‘চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা বর্তমানে একেবারে বেকার। পরিবারের সদস্যেরা এক বেলা খেয়ে দুই বেলা না খেয়ে দিন পার করছেন। কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন।’

আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা গোলাম বলেন, স্বয়ংক্রিয় চালকলের সংখ্যা বৃদ্ধি, ধানের দাম বেড়ে যাওয়া, মূলধন হারানোসহ বিভিন্ন কারণে সাধারণ চালকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।