সংসারের অভাব ঘোচাতে গিয়ে ছেলেটি নিজেই এখন বোঝা

দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে মানিক মিয়াকে এখন ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে হয়। সম্প্রতি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার গাঁও গৌরীপুর চকপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বয়স সবে ১৫। চেহারায় এখনো শৈশবের ছাপ। অল্প বয়সে নির্মম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সংসারের অভাব ঘোচাতে অপ্রাপ্ত বয়সেই নির্মাণশ্রমিকের কাজ নেয়। সেই কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ডান পা হারিয়ে এখন ঘরে বসে দুঃসহ সময় কাটছে তার।

ছেলেটির নাম মানিক মিয়া। বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার গাঁও গৌরীপুর চকপাড়া গ্রামে। বাবা বাবুল মিয়ার একটি হাত অচল। মা জুলেখা খাতুন গৃহিণী। পাঁচ ভাইয়ের সংসারে তিন ভাই আলাদা সংসার পেতেছেন। অভাবের কারণে তাঁরাও সেভাবে সহযোগিতা করতে পারেন না।

অভাবের মধ্যে কোনোমতে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিল মানিক। ২০২০ সালে করোনার সময় ষষ্ঠ শ্রেণিতে তার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। করোনার কারণে বাড়িতেও সংকট দেখা দেয়। সংসারের অভাব ঘোচাতে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

মানিকের পরিবার ও এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ঢাকায় গিয়ে নির্মাণশ্রমিকের কাজ নেয় মানিক। শুরুতে ভালোই চলছিল। ঢাকায় নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ মেটানোর পর বাড়িতেও প্রতি মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে পারছিল সে। হঠাৎ একদিন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মানিক। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভবনের পাইলিংয়ের কাজ করার সময় ভারী যন্ত্র পড়ে নিজের ডান পা হারায় সে। এরপর ২০ দিন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসার সময় তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসা শেষে এখন গ্রামের বাড়িতে দুঃসহ সময় কাটছে তার।

সম্প্রতি গাঁও গৌরীপুর চকপাড়া গ্রামে মানিক ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। মানিক প্রথম আলোকে বলে, দুর্ঘটনার পর জীবনটা বিষাদে ভরে গেছে। সংসারের অভাব মেটানোর ইচ্ছায় বাড়ি থেকে বের হয়ে কাজে যোগ দিয়েছিল সে। কিন্তু ভাগ্যের কাছে হার মেনে আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে। এখন নিজের কাজও করার ক্ষমতা হারিয়েছে সে। দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরে শুয়েবসে কাটে তার। মাঝেমধ্যে ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করে। এভাবেই চলছে তার জীবন।

মানিকের মা জুলেখা খাতুন বলেন, পাঁচ ছেলের মধ্যে অভাবের কারণে বড় তিন ছেলে বাড়িছাড়া। বিয়ে করে তারা আলাদা সংসার করছে। পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর মতো আর্থিক ক্ষমতা তাঁদের নেই। চতুর্থ ছেলেও বাড়িতে বেকার বসে আছে। সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ছোট ছেলে মানিকের পঙ্গুত্ব মেনে নিতে পারছেন না তিনি।

জুলেখা খাতুন বলেন, চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, কৃত্রিম পা লাগাতে পারলে মানিক কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। কিন্তু কৃত্রিম পায়ের জন্য অনেক টাকা দরকার। টাকার জন্য বিভিন্ন জায়গায় সহযোগিতা চেয়েও পাননি।

মানিকের ভাই কাউসার মিয়া বলেন, যে ব্যক্তি মানিককে কাজে নিয়ে গিয়েছিলেন, দুর্ঘটনার পর তিনি ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁকেও আর পাওয়া যায় না। কেউ কোনো খোঁজখবর নেন না।

গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফৌজিয়া নাজনীন প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনা মানিকের পা হারানোর খবরটি সম্প্রতি জানতে পেরেছেন। তবে মানিকের পরিবার সাহায্যের জন্য লিখিত কোনো আবেদন করেনি। আবেদন করলে স্থানীয়ভাবে তার চিকিৎসায় সহযোগিতা করার চেষ্টা করবেন বলে তিনি জানান।