অবরোধে বাস চালিয়ে খাবার খরচও উঠছে না খুলনার পরিবহনশ্রমিকদের

খুলনা নগরের সোনাডাঙ্গা আন্তজেলা বাস টার্মিনালে অলস সময় পার করছিলেন পরিবহনশ্রমিকেরা। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

‘পাইকগাছা থেকি টিপ নিয়ে খুলনায় আয়ছি। ডেরাইভার হাতে ৩০০ ট্যাকা ধরায় দেছে। এহন এই ৩০০ ট্যাকা নিয়া কী করমু তা-ই ভাবতেছি। বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম, এই ট্যাকায় কিচ্ছু হবো না।’ এসব কথা বলছিলেন খুলনার সোনাডাঙ্গা আন্তজেলা বাস টার্মিনালের আবদুস সাত্তার নামের এক পরিবহনশ্রমিক। খুলনা-পাইকগাছা রুটের একটি বাসে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই রুটের বাস কাউন্টারের পাশের একটি চায়ের দোকানে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আশপাশের আরও কয়েকটি চায়ের দোকান আছে। সেখানে বসে ছিলেন আরও অনেক পরিবহনশ্রমিক। ওই বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ১৮টি রুটে বাস চলাচল করে। অন্য সময় ব্যাপক লোকজনের ভিড় থাকলেও গতকাল অবরোধের মধ্যে তা ছিল না। যদিও পরিবহনশ্রমিকেরা নিয়মিত বাস চালিয়ে যাচ্ছেন।
কয়েক দিন ধরে যাত্রীর খরা প্রায় সব রুটে। যাত্রী কম থাকায় নির্ধারিত সময় পরিবর্তন করে বাসের সংখ্যাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবদুস সাত্তার জানালেন, যাত্রী যত বেশি হবে, বাসচালক ও সহকারীদের আয় তত বাড়বে। কিন্তু এখন বেতনের অর্ধেক টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক সময় পথখরচও উঠছে না। যাত্রীরা বেশ আতঙ্কে আছেন। এ কারণে কেউ খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হচ্ছেন না।

সাত্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আরও কয়েকজন পরিবহনশ্রমিক জড়ো হন সেখানে। সাহেব আলী নামের এক বাসচালক বলেন, খুলনা থেকে পাইকগাছায় যেতে তেলে খরচ হয় ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা। সেখানে গতকাল পাইকগাছা থেকে খুলনায় যাত্রী নিয়ে এসেছেন, নগদ পেয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৮০০ টাকা। চালক ছাড়া তাঁর বাসে আরও দুজন সহকারী হিসেবে কাজ করেন। ওই টাকার মধ্যে গাড়ির মালিকের হাতেই-বা কত টাকা দেবেন, আর দুজন সহকারীকেই-বা কত টাকা দেবেন। সেই সঙ্গে নিজের টাকাও তো রয়েছে।

এরই মধ্যে কথা বলে ওঠেন আরেক বাসচালকের সহকারী শফিকুল ইসলাম। তিনি খুলনা-মোংলা রুটের একটি বাসের শ্রমিক।। শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০০ থেকে ৩০০ টাকায় এখন কিছুই হয় না। হোটেলে এক বেলা ডাল-ভাত খাইতে ৫০ টাকার ওপরে চলে যায়। এক কেজি পেঁয়াজ ১২০ টাকা, রসুন ২৫০ টাকারও বেশি। অন্যান্য সবজিরও দাম আকাশছোঁয়া। এক দিনের ৩০০ টাকা আয় দিয়ে এখন কিছুই করা সম্ভব হয় না।’

রিয়াজ হোসেন নামের খুলনা-সাতক্ষীরা রুটের একজন বাসশ্রমিক বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যে বাস নিয়ে চলাচল করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে যেমন বাসের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, অন্যদিকে জীবনের ঝুঁকিও থেকে যায়। শত ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাচ্ছেন তাঁরা। তারপরও আয় তেমন হচ্ছে না। শুধু শুধু কষ্ট করতে হচ্ছে।
রাশেদুল ইসলাম নামের আরেক পরিবহনশ্রমিক বলেন, দেশে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, এমন অবস্থা আরও কয়েক দিন চললে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। রাস্তায় বসে ভিক্ষা করতে হবে। রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছেন পরিবহনশ্রমিকেরা।

অন্য শ্রমিকেরা জানালেন, যখন স্বাভাবিকভাবে বাস চলাচল করে, তখন প্রতিবার ট্রিপে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মতো থাকে। সেখান থেকে চালক পান ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও অন্য সহকারীরা পান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো। কিন্তু এখন কেউ অর্ধেক টাকাও পাচ্ছেন না। শুধু তা-ই নয়, একটি গাড়ি দিনে একবারের বেশি ট্রিপ করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে খাবারের টাকা জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।

শ্রমিকদের ভাষ্য, মালিক ও শ্রমিক নেতারা চাইছেন, যেকোনোভাবেই হোক বাস চলাচল স্বাভাবিক রাখতে। এতে দলীয় নেতাদের কাছে তাঁদের ভাবমূর্তি ভালো থাকে। তাঁরা দেখাতে পারেন, হরতাল-অবরোধ পালন করতে দেননি। এতে ভবিষ্যতে ওই নেতারা বিশেষ সুবিধা পাবেন। তা ছাড়া বাস না চালালে তালিকা করে রাখছেন নেতারা। স্বাভাবিক সময়ে হঠাৎ করে ওই বাসটি বন্ধ করে দেবেন তাঁরা। এ কারণে একপ্রকার বাধ্য হয়েই বাস চালাচ্ছেন পরিবহনশ্রমিকেরা।