সুখবর
হিজড়া দলটি এখন কৃষিজীবী
হিজড়া দলটি দোকানপাট, বাসাবাড়ি থেকে টাকাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলত। এতে বিরক্ত ছিলেন এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ীরা।
ধান চাষ করা হয়েছে প্রায় ১৩ বিঘা জমিতে। দুই বিঘা জমিতে করা হয়েছে টমেটো, লালশাক, মরিচ, পেঁয়াজ, লাউ, পটোলসহ নানা জাতের সবজি। গড়ে তোলা হয়েছে গরু আর মুরগির খামার। গাজীপুর মহানগরীর বাইমাইল এলাকায় ৫০ জনের একদল হিজড়া শুরু করেছেন এসব কৃষিকাজ। আত্মনির্ভরশীল হতেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা।
হিজড়া দলটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনাবাড়ি বাইমাইল এলাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ী ওসমান আলীর কাছ থেকে ছয় মাস আগে জমি নিয়ে তাঁরা কৃষিকাজ শুরু করেছেন। তাঁদের আত্মনির্ভরশীল করার সুযোগ করে দিতে জমির মালিক জমি ব্যবহারের বিনিময়ে কোনো টাকা নেবেন না।
বাইমাইল বিলে উঁচু একটি স্থানে প্রায় ১৫ বিঘা জমির একটি ইটভাটা ছিল। সেটির কার্যক্রম চার–পাঁচ বছর ধরে বন্ধ। জমিও পড়ে ছিল। জমিটির মালিক ওসমান আলী বলেন, ‘কয়েকজন হিজড়া এসে আমার কাছে টাকার বিনিময়ে জমি বর্গা চায়।
যেকোনো কৃষককেই সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়। হিজড়ারা যোগাযোগ করলে অন্য সবার মতো তাদেরকেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হবে।মো. সাইফুল ইসলাম, গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক
পরে আমি সিদ্ধান্ত নিই ওরা যেহেতু কিছু করতে চায়, তাই বিনা পয়সায় তাঁদের জমিটি চাষাবাদ করতে দিই। আমি নিজেও অবাক হয়েছি ওরা খুবই ভালো চাষাবাদ করেছে। গ্রামের মানুষ ও বাজারের ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আর অবাক করার মতো তাঁদের খেতে ধান হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হিজড়া দলটি দোকানপাট, বাসাবাড়ি থেকে টাকাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলত। এতে বিরক্ত ছিলেন এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ীরা। সুযোগ পেয়ে তাঁরা এখন চাঁদা তোলা ছেড়ে কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। জমিতে তাঁদের রোপণ করা বিআর-২৯ জাতের ধান দিন পনেরো পর কাটা যাবে। তাঁদের লাগানো পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, পটোল, করলাসহ বিভিন্ন সবজি ওঠানো শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া বাড়িতে একটি গরুর খামারও করেছেন হিজড়ারা, সেখানে রয়েছে ছোট-বড় ২০টি গরু। আছে গাভিও। সবজিখেত থেকে সবজি বিক্রি করে প্রতিদিন দেড়-দুই হাজার টাকা আয় হচ্ছে। গাভির দুধ বিক্রি থেকেও প্রতিদিন আয় হচ্ছে। রয়েছে ৫০০ কক মুরগির একটি খামার। হিজড়ারাই এসব পরিচর্যা করছেন, পাশাপাশি দিনমজুর দিয়েও কাজ করাচ্ছেন।
হিজড়াদের দলনেতা সাহিদা আক্তার বলেন, ‘আমরা কৃষিকাজ করছি, ধান লাগিয়েছি। গরু ও মুরগি পালন করছি—এটা আপনারা বেশি করে প্রচার করুন। এতে সমাজে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে হিজড়ারাও অনুপ্রাণিত হবে। এগুলো করতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। আমাদের প্রত্যেক সদস্য টাকা দেন, এ জন্য কত টাকা খরচ হচ্ছে সেটির হিসাব রাখা হয়নি। সত্যি বলতে আমরা সবাই খুশি। এসব কাজে আমরাও কাজ করেছি এবং লোকদের টাকা দিয়েও করিয়েছি। সবার সহযোগিতা পেলে আমরা আরও বড় পরিসরে করতে চাই।’
হিজড়াদের ভাষ্য, সাধারণ মানুষের মতো তাঁদেরও হাত-পা আছে, পরিশ্রম করতে পারেন। তাই তাঁরা সাধারণ মানুষের মতো কর্ম করে চলতে চান। সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা এগিয়ে এলে তাঁরা স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করে জীবনযাপন করতে পারবেন। করোনা মহামারির পর থেকে নামে-বেনামে অনেক হিজড়া বেড়েছে। চাঁদা চাইতে গিয়ে অনেক সময় মানুষের রোষানলেও পড়তে হয়। বিবেকবোধ থেকেই তাঁরা কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন।
গত রোববার সরেজমিন দেখা যায়, ধানখেত পরিচর্যা করছেন কালু ওরফে শিল্পী হিজড়া। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন দিনমজুর করছেন। গ্রামের কয়েকজন এসেছেন খেত থেকে টমেটো আর লালশাক নিতে। ধানখেতের পাশেই বানানো হয়েছে ছোট একটি কুঁড়েঘর। সেখানে বসে দেখভাল করেন হিজড়ারা।
সেখানেই কথা হয় কালু হিজড়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাগো এলাকায় কেউ এহন আর কৃষি কাজ করেন না। আমি ছোটবেলা থাইক্যা কৃষিকাজ করতে ভালোবাসতাম। হের লাইগা আমরা (হিজড়া) টেহা জমাইয়া ধান ও সবজি চাষ করছি। জমির মালিকও কইছে, তোরা চাষ কইরা খা। কোনো টাকাপয়সা দেওয়ান লাগব না।’
কালু আরও বলেন, ‘অন্যদের চেয়ে আমি বেশি খেতে সময় দিই। নিয়মিত পানি দিই, পরিচর্যা করি। গরুর খামারে খাবার দিই। খেতের পাশে বসে সবজি বিক্রি করি। আমাগো এলাকায় কেউ চাষাবাদ করেন না। আমরা করছি, তাই সবাই আমাদের ভালো বলছে। মানুষ আরও জমি দিতে চাচ্ছে, তাই আগামী বছর আরও বেশি জমিতে চাষাবাদ করব।’
হিজড়াদের কৃষিকাজকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যেকোনো কৃষককেই সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হয়। হিজড়ারা যোগাযোগ করলে অন্য সবার মতো তাদেরকেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হবে।