শেরপুরের মাঠা-ঘোল যাচ্ছে সারা দেশে, দৈনিক অর্ধকোটি টাকার বেচাবিক্রি

চুলায় বড় কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। দুধ থেকে তৈরি হবে দই। এরপর তৈরি করা হবে মাঠা। গত বুধবার একটি কারখানায়ছবি: প্রথম আলো

দেশের সব জেলায় কমবেশি মাঠা ও ঘোল তৈরি হয়। তবে অনন্য স্বাদ ও মানে বগুড়ার শেরপুরের মাঠা ও ঘোলের সুখ্যাতি সারা দেশে। উত্তরাঞ্চলের জেলার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে যাচ্ছে শেরপুরের মাঠা ও ঘোল। সারা বছর কমবেশি বেচাবিক্রি হলেও পবিত্র রমজান মাসে ইফতারে দধিজাত এ পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজার শুরু থেকে শেরপুর ও আশপাশের এলাকার শতাধিক কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার লিটার বোতলজাত মাঠা ও ঘোল বিক্রি হচ্ছে। এসব মাঠা ও ঘোল ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। প্রতি লিটার মাঠা ও ঘোল পাইকারি পর্যায়ে গড়ে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। সেই হিসাবে দৈনিক বেচাবিক্রি হচ্ছে অর্ধকোটি টাকার বেশি।

শেরপুরের প্রসিদ্ধ শাম্বা দধি অ্যান্ড সুইটসের মালিক রকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছর মাঠা ও ঘোল বিক্রি হলেও রমজান মাসে মূল ব্যবসা হয়। আদিকাল থেকেই রোজাদারদের কাছে মাঠা ও ঘোলের কদর বেশি। এখন সারা দেশে মাঠা ও ঘোলের বাজার ছড়িয়ে পড়েছে। শেরপুরের তৈরি মাঠা ও ঘোল ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চলে যাচ্ছে। বোতলজাত মাঠা ও ঘোল রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণের পর তা পাঠানো হয়।

মাটির ঢোপ থেকে বোতলে

একসময় মাটির হাড়িতে ঘোল ও মাঠা বিক্রি হলেও এখন বোতলজাত করে বিক্রি করা হয়
ছবি: প্রথম আলো

শেরপুরের ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা একসময় গ্রামগঞ্জে ঘুরে দই বিক্রি করতেন। গ্রীষ্মে শহর কিংবা গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে বসে মাটির ঢোপে ঘোল ও মাঠা বিক্রির প্রচলন ছিল। সত্তরের দশকে এক গ্লাস ঘোল মিলত দুই পয়সায়। কালের বিবর্তনে ব্যবসার ধরন পাল্টেছে। এখন শহরের সুসজ্জিত শোরুমে বোতলজাত মাঠা ও ঘোল বিক্রি হচ্ছে। ইফতার ছাড়াও বিয়েশাদি, ঈদ, নববর্ষসহ বিভিন্ন উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে মাঠা ও ঘোলের কদর আছে।

কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শেরপুরের ঘোষপাড়ার নীলকণ্ঠ ঘোষের হাত ধরে প্রায় ১৫০ বছর আগে ১৮৬০ বা ৭০ সালের দিকে বগুড়ার দইয়ের যাত্রা শুরু হয়। পাশাপাশি ঘোলও বিক্রি করতেন ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন। তখন ঘোষেরা ঘোল তৈরি করে ছোট ছোট হাঁড়িতে করে গ্রামগঞ্জে বিক্রি করতেন। গত শতকের শুরুর দিকে বগুড়ার নওয়াব আলতাফ আলী চৌধুরীর (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বাবা) পৃষ্ঠপোষকতায় ঘোষপাড়ার গৌর গোপাল পাল বগুড়া শহরে দই উৎপাদন ও বিক্রি শুরু করেন। গত শতক পর্যন্ত মাটির হাঁড়িতে করে ঘোল বিক্রি হলেও চলতি শতকের শুরুতে বোতলে করে ঘোল ও মাঠা বিক্রি শুরু হয়।

শেরপুরের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ২০০৭ সালে শেরপুরে দইয়ের কারখানায় বোতলজাত মাঠা ও ঘোল উৎপাদন শুরু হয়। প্রথমে সম্পা দধি ভান্ডারের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল চন্দ্র ঘোষ বোতলে করে ঘোল ও মাঠা বাজারজাত করেন। এর পর থেকে বোতলজাত মাঠা ও ঘোলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বর্তমানে ২৫০, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটার বোতলের মাঠা ও ঘোল বাজারজাত হচ্ছে। পাইকারি পর্যায়ে ২৫০ মিলি মাঠা ও ঘোল ৩০ টাকা, ৫০০ মিলি ৫০ টাকা এবং এক লিটার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রি হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে

স্বাদ ও মান বিবেচনায় প্রসিদ্ধ মাঠা ও ঘোল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের মাঠা ও ঘোল, আদি মহররম আলীর মাঠা ও ঘোল, চিটাগাং নুর হোটেলের মাঠা ও ঘোল, শেরপুর দইঘরের মাঠা ও ঘোল, সাউদিয়ার মাঠা ও ঘোল, জলযোগের মাঠা ও ঘোল, বৈকালী ও শুভ দধি ভান্ডারের মাঠা ও ঘোল, শম্পা দধি ভান্ডারের মাঠা ও ঘোল প্রসিদ্ধ।

বৈকালী দই-মিষ্টি ঘরের স্বত্বাধিকারী পার্থ কুমার সাহা বলেন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, মান নিয়ন্ত্রণ ও কারখানার স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের কারণে মাঠা ও ঘোলের বাজার ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে। অনেক ঘোষ বাড়ি ও কারখানা খুচরায় মাঠা বা ঘোল বিক্রি করে না। তাদের দিয়ে মাঠা ও ঘোল তৈরি করিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামে বিক্রি করে।

শম্পা দধি ভান্ডারের ব্যবস্থাপক তপন ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, সারা বছর কদর থাকলেও রমজানে ঘোল ও মাঠার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। নিজস্ব শোরুম থেকে প্রতিদিন গড়ে আধালিটারের পাঁচ শতাধিক বোতলের মাঠা বিক্রি হয়।

শেরপুরের আদি জলযোগ সুইটস প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিমল বসাক বলেন, তাঁদের কারখানায় তৈরি ঘোল ও মাঠা বিক্রি হচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায়। প্রতিদিন এখানকার কারখানা থেকে হাজার হাজার বোতল মাঠা ও ঘোল বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে।

কারখানায় এক দিন

৫ মার্চ শেরপুরের শাহবন্দেগী ইউনিয়নের হামছায়াপুর এলাকায় কোয়ালিটি মিল্ক টেস্টি মাঠা কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, একদল কারিগর মাঠা তৈরি করছেন। অন্যরা বিভিন্ন আকারের বোতলে তা ভরছেন। দলে দলে গোয়ালারা ভাঁড়ে করে দুধ নিয়ে আসছেন। সেই দুধ বড় কড়াইয়ে ঢেলে চুলায় বসানো হয়েছে। জাল দিয়ে ঘন করে লবণ ও চিনি মিশিয়ে ঠান্ডা করার পর মাঠা বানিয়ে বোতলজাত করা হচ্ছে।

কলেজছাত্র আসিফ আল হাসান (২২) ও নাঈম হাসান (২৩) পড়ালেখার পাশাপাশি কারখানায় মাঠা তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করেন। জানালেন, কলেজ বন্ধ থাকায় বাড়তি উপার্জনের জন্য তাঁরা মাঠা তৈরির কাজ করছেন। ঈদের আগে এই টাকা তাঁরা পরিবারের হাতে তুলে দেবেন।

কারখানায় তৈরি করা মাঠা বাজারজাতকরণের জন্য প্রস্তুত করছেন দুই নারী। গত শুক্রবার দুপুরে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার হামছায়াপুর মহল্লায়
ছবি: সোয়েল রানা

কারখানার মালিক আবদুর রশিদ বলেন, তাঁদের কারখানার মাঠা মূলত ঢাকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়। কারখানার ব্যবস্থাপক জাহিদুল ইসলাম বলেন, দুই বছর ধরে এই কারখানায় মাঠা উৎপাদন হচ্ছে। রমজান মাসে চাহিদা বেশি থাকায় কারিগরদের দম ফেলার ফুসরত থাকে না। প্রতিদিন গড়ে ১২ মণ দুধের মাঠা তৈরি হয় এখানে।

শেরপুর শহরের ঘোষপাড়ায় চৈতি দধি ভান্ডার কারখানায় একই দৃশ্য দেখা গেল। কারখানার মালিক সদানন্দ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, কারাখানায় উৎপাদিত মাঠা ও ঘোল বগুড়ার বড় বড় মিষ্টির দোকান ছাড়াও পাইকারদের হাত ঘুরে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের নামীদামি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে।