পুলিশের গুলিতে আসামির বাবা নিহতের ঘটনায় ক্ষোভ, ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

পুলিশের গুলিতে নিহত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার আদমপুরের বাসিন্দা আইয়ুব নূরের বাড়ি। আজ শুক্রবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় পুলিশের গুলিতে আইয়ুব নূর (৬০) নামের এক ব্যক্তি নিহতের ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ১৮ জনকে আসামি করে থানায় একটি মামলাও করেছে।

পুলিশের ভাষ্য, মাদক মামলার আসামিকে ধরতে গেলে অন্য ব্যবসায়ীরা পুলিশের ওপর হামলা করেন। আত্মরক্ষায় পুলিশ পাল্টা গুলি চালিয়েছে। হামলায় পুলিশের ১০ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশ দাবি করছে, নিহত আইয়ুব নূর একজন মাদক ব্যবসায়ী। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক মামলাসহ পাঁচটি মামলা আছে।

তবে নিহত ব্যক্তির পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ যে আসামিকে ধরতে বাড়িতে গিয়েছিল, সেখানে আসামি না থাকার পরেও পুলিশ তাঁদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। এতে বাধা দিলে পুলিশ আসামির বাবা আইয়ুব নূরকে গুলি করে হত্যা করে। আর পরিবারের নারীসহ আরও দুই সদস্যকে মারধরের পর গুলি করে। যদিও এসব ঘটনাকে ‘সাজানো নাটক’ বলেছে পুলিশ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। স্বজনসহ স্থানীয় লোকজন হামলা চালালে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোড়ে। এখন তাঁরা নিজের গা বাঁচাতে কত কথাই তো বলবেন।’

আরও পড়ুন

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইয়ুব নূরের দুজন স্ত্রী। তাঁরা আলাদা সংসার নিয়ে পাশাপাশি দুটি বাড়িতে থাকেন। ঘটনার রাতে আইয়ুব দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িতে ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর বাড়িতে চিৎকার–চেঁচামেচি শুনে তিনি এগিয়ে আসেন।

আইয়ুবের পুত্রবধূ শাবনাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাদাপোশাকে পুলিশ এসেছিল। প্রথমে বাড়িতে ঢুকে ফটক খুলতে বলে। আমার স্বামীর (আরিফ নূর) খোঁজ করছিল তারা। বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক না থাকায় আমরা দরজা খুলিনি। পুলিশ তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে আলমারি ভাঙচুর করে। আমার বাঁ গালে থাপ্পড় দেয় একজন। এরপর লাঠি দিয়ে আমাকে বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে, ডান পায়ের ঊরুতে ও পিঠে মারধর করে। আমরা জা সুইটি ও শাশুড়িকেও তারা মারধর করে। বাইরে উঠানে এসে এসবের প্রতিবাদ করেন আমার শ্বশুর। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে কাছ থেকে শ্বশুরকে গুলি করে পুলিশ।’ তিনি বলেন, ‘আসামিকে গ্রেপ্তার করতে এসে পুলিশ মারধর ও গুলি চালাবে কেন?’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বাসিন্দা আইয়ুব নূর
ছবি: সংগৃহীত

আজ শুক্রবার সকালে সরেজমিনে আদমপুর গ্রামে দেখা যায়, চারপাশের পরিবেশ অনেকটা নীরব। নিহতের বাড়ির ঠিকানা দেখালেও ঘটনা সম্পর্কে কেউ তেমন কিছু বলছেন না। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহতের স্ত্রী কোমরে ব্যথা পেয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন।

নিহতের ভাই মলাই ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলির শব্দ শুনে আমরা এগিয়ে যাই। তখন আমার ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় উঠানে, রাস্তার এক পাশে ছেলের বউ সালমাকে ও আরেক পাশে নাতি ইমনকে পড়ে থাকতে দেখি। ছেলের বউ সালমার চোখে ছররা গুলি লেগেছে।’

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত আইয়ুবের ছেলে আরিফ নূরের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচটি মামলা এবং আরেক ছেলে তোফাজ্জল নূরের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১০টির বেশি মামলা আছে। এর মধ্যে সম্প্রতি আরিফ নূরের বিরুদ্ধে মাদক মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ওই পরোয়ানার সূত্র ধরে গত বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে আদমপুর গ্রামের গাবুন্নিমুড়া এলাকায় আইয়ুব নূরের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় ওই বাড়ি থেকে আরিফকে গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরায় পুলিশ। হাতকড়া পরানো অবস্থায় স্বজনেরা আরিফকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। একপর্যায়ে তাঁরা পুলিশের ওপর হামলা চালান। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে আইয়ুব নূর, সালমা (২৫) ও ইমন (১১) নামের তিনজন আহত হন।

পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় লোকজন জানান, আইয়ুব বুকের ডান পাশে, শিশু ইমন পিঠে এবং সালমা বুকে, গলা ও মুখে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের উদ্ধার করে প্রথমে বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় নেওয়ার পথে আইয়ুব নূর মারা যান। বাকিরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা রানা নুরুস শামস ও ময়নাতদন্ত করা চিকিৎসক মো. সোলায়মান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, নিহত আইয়ুব নূরের শরীরে একাধিক ছররা গুলির ক্ষত ছিল। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েই মারা গেছেন। ময়নাতদন্তে পাওয়া উপাদানগুলোর ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য ঢাকার মালিবাগের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মো. জয়নাল আবেদীনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পুলিশ। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. বেলাল হোসেন ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ডিআইও-১) আজাদ রহমান। তদন্ত কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান খান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. বেলাল হোসেন।

বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজু আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় এএসআই মো. সেলিম বাদী হয়ে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৭০-৮০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। এই আসামিরা মাদক মামলার পরোয়ানাভুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তারের পর হাতকড়াসহ ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়।

সাদাপোশাকে পুলিশের অভিযান, বাড়িতে আসামি না থাকা এবং ঘরে ভাঙচুর করে নারীদের মারধরের বিষয়ে ওসি বলেন, এসব মিথ্যা ও সাজানো অভিযোগ। আদমপুরের ওই জায়গা মাদকপ্রবণ এলাকা। মারা যাওয়া আইয়ুবসহ তাঁর ছেলে মাদক ব্যবসায়ী। তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলাসহ একাধিক মাদকের মামলা আছে।