কৃষককে মাঠে ফেরাবে কে

লবণাক্ততা বাড়লেও তা মোকাবিলায় সেচের ব্যবস্থা নেই। দূর থেকে পানি এনে জমিতে দিতে হয়। সন্দ্বীপের বাউরিয়ায়ছবি: প্রথম আলো

একদিক থেকে সন্দ্বীপ যেন দেশের মধ্যে একখণ্ড ‘বিদেশ’। সিঙ্গাপুর বা ব্রুনাইয়ের বাসিন্দাদের শাকসবজি যেমন আসে মালয়েশিয়া থেকে, তেমনি সন্দ্বীপের মানুষের ভাতের পাতে সবজি আসে যশোর, নরসিংদী থেকে। কেননা, সন্দ্বীপে এখন আর শাকসবজির চাষ নেই বললেই চলে। সন্দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন কী পরিমাণে শাকসবজি এখানকার আড়তদারেরা নিয়ে আসেন, সেই পরিসংখ্যানেই ফুটে ওঠে সন্দ্বীপের কৃষির দুরবস্থা।

কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট থেকে গাড়ির হিসাব ও সন্দ্বীপের প্রধান দুটি আড়ত থেকে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, প্রতিদিন অন্তত ৯০ টন শাকসবজি চট্টগ্রাম হয়ে সন্দ্বীপে ঢুকছে। তার মানে, বছরে প্রায় ৩৩ হাজার মেট্রিক টন শাকসবজি এই উর্বর মাটির দ্বীপের বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ সালে সন্দ্বীপে মোট সবজি উৎপাদন হয়েছে ৬০ হাজার ১০১ মেট্রিক টন। তাঁদের এই দাবি কতটা যথার্থ, সে বিতর্কে না গিয়ে বরং ভেবে দেখা যেতে পারে, সন্দ্বীপের মাত্র ৭ শতাংশ কৃষিজমিতে (প্রথম পর্বে এর ব্যাখ্যা আছে) এই পরিমাণ সবজি ফলছে। অন্তত ৫০ শতাংশ জমিও যদি সবজি চাষের আওতায় আনা যেত, তবে তো লাখ লাখ টন শাকসবজি বাইরে বেচে লাভবান হতে পারতেন সন্দ্বীপের কৃষক।

স্থানীয় চৌমুহনী বাজারের ‘মা-বাবার দোয়া’ নামক আড়তের মালিক মো. দুলাল জানিয়েছেন, ৩০-৩৫ বছর আগে তাঁর বাবা এই আড়তের ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে অল্প পরিমাণে আনা হলেও গত ১৫-২০ বছরে বাইরে থেকে সবজি আনার হার দ্রুত বেড়েছে। দুলালের কথা মিলে যাচ্ছে মাঠের কৃষকের সঙ্গে। কৃষকের দাবি অনুযায়ী, কৃষিতে প্রকৃতির অত্যাচার শুরু হয়েছে দুই যুগ আগে থেকে। গত পাঁচ-সাত বছরে এই অত্যাচারের তীব্রতা বেড়েছে।

খরা, লবণাক্ততা, রোগবালাই, অকালবর্ষণ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে সন্দ্বীপের কৃষক কী ধরনের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন; প্রকৃতির বৈরিতা কৃষক কীভাবে একাই মোকাবিলা করছেন; কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৮টি সংস্থার বিশাল লটবহর বিপর্যস্ত কৃষকের কতটুকু কাজে লাগছে ইত্যাদি উঠে এসেছে এই পর্বে।

কিন্তু সন্দ্বীপের প্রান্তভাগের কিছু জায়গার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কৃষক যেমন আশ্চর্য হয়েছেন, তেমনি অবাক হতে হয়েছে এই প্রতিবেদককেও। অনেক কৃষকের দাবি, কৃষি বিভাগের কোনো কর্মকর্তাকে তাঁরা চোখেও দেখেননি। অনেকের মতে, কৃষি নিয়ে ভাবার জন্য ‘সরকারি লোক’ আছেন, এটি তাঁরা জানেনই না! মগধরা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৬৫ বছর বয়সী কৃষক মো. জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষির খবর লইতে সরকার লোক রাইখছে, এইটা এই প্রথম হুনছি (শুনছি)।’

আরও পড়ুন

একদিকে মাঠে যেমন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারীদের দেখা মিলছে না, তেমনি ‘খুবই ব্যস্ত’ থাকায় ঢাকার খামারবাড়ির দপ্তরে গিয়েও সাক্ষাৎ মেলেনি অধিদপ্তরটির মহাপরিচালক মো. ছাইফুল ইসলামের। তবে পরিচালক সাহিনুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সপ্তাহে চার দিন উপসহকারীদের মাঠ পরিদর্শন করে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। সন্দ্বীপের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মারুফ হোসেনের দাবি, তিন দিন উপসহকারীরা মাঠে গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। বাকি তিন দিন বসছেন ইউনিয়ন পরিষদে। অবশ্য কৃষি কর্মকর্তার এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রথম আলোর সমীক্ষায় অংশ নেওয়া কৃষকের ৮০ শতাংশ।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, শতভাগ কৃষকই জানেন লবণাক্ততা বাড়ছে। কিন্তু ৯৮ শতাংশ কৃষকের জানা নেই, লবণাক্ততা কীভাবে দূর করতে হবে। সমীক্ষা ও অনুসন্ধান বলছে, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কৃষকদের এসব প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

জলবায়ু তহবিলে উপেক্ষিত কৃষি

মাঠের কৃষক যখন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে একবারের জায়গায় দুই বা তিনবার পর্যন্ত ফসল বুনে মাঠে টিকে থাকার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট সন্দ্বীপের পৌর এলাকার রাস্তাঘাট আলোকিত করার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে সন্দ্বীপ পৌরসভায় সৌরশক্তিচালিত সড়কবাতি স্থাপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সন্দ্বীপের কৃষি খাতে এই তহবিলের কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি বলে জানা গেছে।

২০১০ সালে প্রণীত জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড নীতিমালায় এটির লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।’ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সন্দ্বীপের কৃষকদের কোনো ধরনের সহায়তা দেওয়ার খবর মেলেনি এই তহবিল থেকে।

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামের কাছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৃষি ও কৃষকের অভিযোজনে তাঁরা কী ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। ‘কৃষি নিয়ে কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে’ দাবি করলেও তিনি নির্দিষ্ট কোনো প্রকল্পের কথা তৎক্ষণাৎ বলতে পারেননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, সরকারি বিভাগগুলো যেসব প্রকল্পের চাহিদা দেয়, ট্রাস্টের পক্ষ থেকে তাঁরা সেগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্পের পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের সঙ্গে তাঁদের কোনো প্রকল্প চালু আছে কি না। তিনি ‘না’ সূচক জবাব দিয়েছেন।

মাটি-লবণ পরীক্ষার দায় কৃষকের

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে সন্দ্বীপের কৃষকেরা ‘নুনা’র (লবণাক্ততার) হাত থেকে মুক্তির আকুতি জানিয়েছেন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ২০০ কৃষকের ১৯৭ জনই লবণাক্ততাকে চাষের অন্যতম হুমকি বলে জানিয়েছেন। মাঠের কৃষকের করুণ পরিণতির দায় যখন এই লবণাক্ততার, তখন জানা গেল, লবণাক্ততা ও মাটি পরীক্ষার দায় কৃষকেরই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে কাজ করছে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটসহ ১৮টি সংস্থা।

কৃষকদের হতোদ্যম অবস্থা ও মাটি পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মারুফ হোসেন বলেছেন, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে গিয়ে কৃষককেই মাটি পরীক্ষা করিয়ে আনতে হবে। কেউ চাইলে তাঁদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারেন।

দ্বীপ উপজেলার দরিদ্র কৃষকেরা হাটহাজারীতে গিয়ে মাটি পরীক্ষার এই আয়োজনকে ‘অসম্ভব’ বলেছেন। কৃষকের টিকে থাকায় মাটি ও লবণাক্ততা পরীক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মসূচি পরিচালক রেজওয়ানা রহমানের কাছে ‘এ দায়িত্ব সম্প্রসারণ বিভাগের কেন নয়’ জানতে চাইলে, তিনি বলেছেন, ‘মাটি বা লবণাক্ততা পরীক্ষার দায়িত্ব মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই), আমাদের নয়।’ এসআরডিআইয়ের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এ ক্ষেত্রে সমন্বয় করে কি না, জানতে চাইলে তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারেননি।

অন্যদিকে চট্টগ্রামের একমাত্র দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের মাটির লবণাক্ততার তথ্য নেই চট্টগ্রাম বিভাগীয় মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের কাছে। এখানকার মাটি ও লবণাক্ততা পরীক্ষা নিকট অতীতে করা হয়নি বলে জানিয়েছেন মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের চট্টগ্রাম বিভাগীয় মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আফছার আলী। মাটি ও লবণাক্ততা পরীক্ষায় কৃষি বিভাগের সঙ্গে তাঁদের সমন্বয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের সঙ্গে এ ধরনের কোনো প্রকল্প নেই তাঁদের।

‘পানি না দিলে নুনা চ্যাতে’

সাগরের লবণজলবেষ্টিত সন্দ্বীপের কৃষকেরা লবণাক্ততা দূর করতে এমওপি বা পটাশ সার এবং টিএসপি ব্যবহারের কথা বলেছেন। কৃষি কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, লবণ তাড়াতে জিপসাম ব্যবহারের কথা। সে কথা পৌঁছায়নি কৃষকের কাছে। লবণাক্ততা দূর করার গবেষণালব্ধ কোনো কৌশলও কৃষি বিভাগ জানাতে পারেনি কৃষকদের। ৮০ শতাংশ কৃষক জানিয়েছেন, কৃষি বিভাগ থেকে এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে কেউ তাঁদের কাছে আসে না। তবে কৃষকেরা জানেন, নুনা দূর করতে তাঁদের পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন। গাছুয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৯০ বছর বয়সী কৃষক চান মিয়া বলেন, ‘পানি না দিলে খরানে নুনা চ্যাতে (তীব্র হয়)। কান্ধে-ভারে (কাঁধে ঝুলিয়ে) মানুষের পইরেত্তে (পুকুর থেকে) পানি আনি নুনা দমান (ঠেকানো) যাইত ন।’

মাঠে ঘুরে কোথাও সেচের কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। সরকারি বন্দোবস্ত তো নেই-ই, আগের মতো খেতের কোনায় নেই খাই-খন্দক আর পুকুরও। ফলে লবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাস্ত কৃষকের নাভিশ্বাস উঠেছে চাষে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কৃষকেরা কাছের কোনো বাড়ি বা মসজিদের চাপকল থেকে, এমনকি খালের মৃদু লবণপানিই ফসলের আঁটিতে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। এতে মাঠে লবণের পরিমাণ আরও বাড়ছে।

সন্দ্বীপের হাজার হাজার কৃষকের সেচসুবিধার বাইরে থেকে যাওয়ার দায় কার—জানতে চাইলে বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মুহাম্মদ বদিউল আলম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠিকাদারের খরচ পুষিয়ে হলেও সেখানে সেচসুবিধা নিশ্চিত করা উচিত। এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলব।’

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচসুবিধা দিতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সন্দ্বীপকে সেই প্রকল্পে যুক্ত করা হবে।

সূর্যমুখীচাষিদের খোঁজে

খরা-লবণাক্ততার এই উপকূলে ৯৪ শতাংশ কৃষকের জানা নেই তাঁদের নোনা জমিতে চাষের উপযুক্ত ফসল কোনটি। ২০২৩ সালে সন্দ্বীপের কৃষকদের মধ্যে উন্নত জাতের সূর্যমুখীর বীজ বিতরণ করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। প্রকৃত কৃষকের বদলে সেই বীজের বেশির ভাগই কৃষিবহির্ভূত শ্রমজীবী অথবা কৃষির সঙ্গে যুক্ত নন, এমন ব্যক্তিদের হাতে পড়েছিল। ফলে সন্দ্বীপে সূর্যমুখী চাষের সম্ভাবনা ঠিক কতটুকু, তা পরখ করতে ব্যর্থ হওয়ার কথা কৃষি বিভাগের। যদিও কৃষি কর্মকর্তার দাবি, তাঁরা সূর্যমুখীর উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিশ্চিত হতে পেরেছেন।

গত বছর সন্দ্বীপের ১০ জন চাষিকে সূর্যমুখীর বীজ (উন্নত জাতের হাইসান ৩০) দেওয়া হলেও তাঁদের মাত্র দুজন সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন। ফলন প্রত্যাশার চেয়ে ভালো হয়েছে কিন্তু বাকি আটজন ‘সূর্যমুখীচাষি’ এই উচ্চমূল্যের বীজ কী করেছিলেন বা কেনইবা তাঁদের এই বীজ দেওয়া হয়েছিল, সেই খবর নেয়নি কেউ। ওই দুই কৃষক সন্দ্বীপের মধ্যভাগের জমিতে সূর্যমুখী ফলিয়েছিলেন। তাঁদের জমিতে অতি উচ্চমানের সূর্যমুখী ভালো ফুল দিয়েছে। কিন্তু প্রান্তভাগের লবণাক্ত জমিতে বা বেড়িবাঁধের বাইরে ফলনের সম্ভাবনা কেমন, তা অজানাই থেকে গেছে।

সূর্যমুখীবীজ প্রদানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক ড. সাহীনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রণোদনার অংশ হিসেবে উপকূলে সূর্যমুখী চাষের সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য কৃষকদের এই বীজ প্রদান করা হয়েছিল।’

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সূর্যমুখীর বীজ পাওয়া চাষিদের খোঁজে নেমে দেখা গেছে, অনেকেই এই বীজ জমিতে না লাগিয়ে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কেউ কেউ এই বীজ খাওয়া যায় কি না, অন্যদের কাছে জানতে চেয়েছেন। অনেকে বুঝতেই পারেননি, সূর্যমুখী কেবলই একটি ফুল, নাকি ফসল। যদি ফসল হয় তবে কী হয় এ থেকে, তা জানতেই পারেননি তাঁরা। তবে যে দুজন কৃষক সূর্যমুখী চাষ করেছিলেন, তাঁদের একজন মগধরা ইউনিয়নের মো. শাহজালাল সূর্যমুখী বীজ নিয়ে পড়েছেন সংকটে। তিনি জানিয়েছেন, এক কেজি বীজ পিষে ৩০ টাকা খরচে তিনি তেল পাচ্ছেন ২৫০ গ্রাম, কিন্তু এই তেল কেউ কিনছে না। তাই ঘরে তোলা আট মণ (৩২০ কেজি) সূর্যমুখী বীজ নিয়ে তিনি বেকায়দায় পড়েছেন। কৃষি বিভাগ এ ক্ষেত্রে তাঁকে কোনো ধরনের সাহায্য করতে পারেনি। গত বছর হারামিয়া ইউনিয়নের মো. মাইনুদ্দিন সূর্যমুখীর বীজ পেলেও তিনি চাষ করেননি। তিনি প্রথম আলোর কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘এটা কীভাবে চাষ করব? আগে চারা করব নাকি মাটিতে বীজ পুঁতে দেব?’

‘মাঠের কৃষক, বাঁটের কৃষক’

‘সার, বীজ, জিনিসপত্র এগুলা তো মাঠের কৃষকেরে দে না, দে বাঁটের কৃষকেরে।’ কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও প্রণোদনা সাহায্য কৃষকের কতটুকু কাজে আসে, তা বোঝার জন্য সাক্ষাৎকারের একটি প্রশ্নের জবাবে এমন অভিযোগ করেছেন ২০০ কৃষকের ১৭০ জন। বাউরিয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক মো. আবছার (৪৫) এমন প্রশ্নে ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, মাঠের কৃষকের চেয়ে বাঁটের (বাঁটোয়ারার) কৃষকের জন্য টান (আগ্রহ) বেশি কৃষি বিভাগের।’

সরকারি প্রণোদনার সার, বীজ ও কৃষি উপকরণ বিতরণের তালিকায় অটোরিকশাচালক, মৎস্যজীবী, বেকার ও গৃহস্থরা স্থান পেলেও নজর দেওয়া হয়নি মাঠের কৃষকের দিকে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত অকৃষিজীবীরা প্রণোদনার সার, বীজ এনে বিক্রি করেছেন প্রকৃত কৃষকের কাছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তালিকার কিছু নাম নিতে হয়েছে স্থানীয় কৃষক লীগের (আওয়ামী লীগ) কাছ থেকে। সূত্রমতে, ওই ধারা এখন আরও জোরদার হয়েছে। ‘কৃষকের’ তালিকা দিতে এখন দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে স্থানীয় কৃষক দল (বিএনপি)। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনে করছেন, এ থেকে পরিত্রাণ মিলবে না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাছ থেকেই কৃষকের তালিকা নেওয়া হয়। ‘তালিকা পেয়ে কৃষক শনাক্তের দায়িত্ব কার’ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এতে আমাদের কিছু করার থাকে না। আমরা চাপে আছি, তাই কিছু নাম নিতেই হয়। মাঠে-প্রান্তরে গেলে আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?’

কৃষি ছাড়ার হুমকি কৃষকের

ইতিপূর্বে উত্তরবঙ্গের একটি উপজেলায় দায়িত্ব পালন করে আসা কৃষি কর্মকর্তা মারুফ হোসেনও সন্দ্বীপের কৃষিকে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি’ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে এ পরিস্থিতি মোকাবিলার বিষয়ে তাঁর দপ্তরের প্রস্তুতি বা কৃষি অভিযোজনের বিষয়ে কোনো সুখবর তিনি দিতে পারেননি।

বছরের আট মাস পতিত থাকা সন্দ্বীপের কৃষিজমিতে যে অল্পসংখ্যক কৃষক এখনো কৃষিতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন, তাঁদের চাওয়া খুবই সুনির্দিষ্ট। খরা, নুনা, রোগবালাই আর দুর্যোগের মুখে টিকে থাকার কৌশল জানতে চান তাঁরা। সেই সঙ্গে তাঁদের দাবি, কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্য যেন কৃষকই পায়। কৃষকদের কাছে প্রথম আলোর একটি প্রশ্ন ছিল, ‘কৃষিকাজ ছেড়ে দেওয়া মানুষেরা পরবর্তিতে কী কাজ করছেন?’ কৃষকেরা জানিয়েছেন, যাঁরা চাষ ছেড়ে দিয়েছেন বা বেকার, তাঁরা অটোরিকশা চালানো, মাছ ধরা, মাটি পরিবহনের ট্রাকে শ্রম দেওয়া অথবা বদলা খাটার মতো কাজ করছেন।

সমীক্ষায় ৪০ শতাংশ কৃষক জানিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে পারেন তাঁরা। অন্যদিকে সেচের পানি, নুনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সুযোগ পেলে চাষাবাদ বাড়ানোর কথা বলেছেন শতভাগ কৃষক। সন্তোষপুর ২ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক দিলদার বলেন, ‘এইভাবে চইলতে থাইকলে চাষ ছাড়ি বেকার থাকন ভালা। টাকা আর পরিশ্রম হিসাব কইরলে লাভ কই? তার উপর এত বালা-মুছিবত আর রোগবালাই সহ্য অইতেছে না।’

জমি পতিত, দায় কার?

কৃষি ও কৃষকের সমস্যা দূর করতে কাজ করছে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কিন্তু কৃষিকে সম্প্রসারণের দায়িত্ব পাওয়া দপ্তরটির কর্মকর্তারাই ঠিক করতে পারেননি, ঠিক কী ধরনের উদ্যোগ সন্দ্বীপের কৃষকদের একটি লাভজনক ও টেকসই কৃষিজীবিকার পথ দেখাতে পারে।

কৃষিজমি পতিত রাখার ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ কী রকম হতে পারে, জানতে চাইলে সন্দ্বীপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনে পতিত জমি সরকারের কাছে ন্যস্ত করার বিধান থাকলেও দেশে কখনো এই আইনের প্রয়োগ হয়নি। এই আইন দিয়ে কৃষক বা জমির মালিকের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যেতে পারে।’

তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম পরিস্থিতি কীভাবে কৃষককে কৃষিজীবিকা থেকে ছিটকে দিচ্ছে, তা সবিস্তার তুলে ধরে ‘স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাহী হিসেবে দায় এড়াতে পারেন কি না’ প্রশ্ন করলে তিনি ‘কিছুটা দায় নিতে প্রস্তুত’ বলে জানান। নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ বাড়ার পর সন্দ্বীপের কৃষিতে কী ধরনের উদ্যোগ ও মনোযোগ প্রয়োজন, সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার তথ্য আমার জানা নেই। এ বিষয়ে যতটুকু সম্ভব আমি চেষ্টা চালাব।’

জলবায়ুর পরিবর্তন মাঠ থেকে কৃষককে দূরে ঠেললেও ‘কারও না কারও ফিরিয়ে আনার দায় আছে’ বলে মনে করেন জলবায়ুবিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। তাঁর মতে, জলবায়ুর পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হলেও এর প্রভাব বেশি পড়ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কৃষক ও শ্রমজীবীদের ওপর। যেহেতু এই পরিবর্তন মোকাবিলার ব্যবস্থা আমাদের নেই, সেহেতু এর সঙ্গে কৃষকদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। প্রকৃতির নিয়মে কৃষকেরা নিজে নিজেই অভিযোজন ক্ষমতা অর্জন করবেন কিন্তু সেই ক্ষমতা দ্রুত অর্জন করার কলাকৌশল ও নীতি নির্ধারণের প্রধান দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর।

খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায় আছে কৃষককে মাঠে ফেরানোর। দায় আছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থারও। কিন্তু তাঁদের দায় অস্বীকারের চেষ্টা বা কৃষকের প্রকৃত দুর্ভোগ উপলব্ধির ব্যর্থতার খেসারত দিচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তনে সংকটে পড়া হাজারো কৃষক। (শেষ)