‘জ্ঞান ফিরলে দেখি আশপাশে কেউ নেই’

করোনা পরীক্ষাপ্রতীকী ছবি

‘আমার জ্বর ছিল কয়েক দিন ধরে। শরীর অনেক খারাপ হয়ে যায়। আমাকে ১ এপ্রিল ভর্তি করা হয় জেনারেল হাসপাতালে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম। রাত সাড়ে তিনটায় জ্ঞান ফিরলে দেখি আশপাশে কেউ নেই। শুধু দূরে এক নার্স পাহারা দিচ্ছেন আমাকে। ৩ এপ্রিল রিপোর্ট আসে যে আমার করোনা হয়েছে।’

চট্টগ্রামের প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী মো. মুজিবুল হক এভাবেই করোনাকালের স্মৃতিচারণা করেন। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিধিনিষেধ চলাকালে ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল মুজিবুল হকের কোভিড-১৯ ধরা পড়ে। ঢাকায় ওই বছরের ৯ মার্চ প্রথম কোভিড রোগী ধরা পড়লেও মুজিবুল হকই চট্টগ্রামের প্রথম করোনা রোগী।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে মুঠোফোনে কথা হয় মুজিবুলের সঙ্গে। নগরের দামপাড়ার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংক কর্মকর্তা এখন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। গতকাল সোমবার তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন, রয়েছেন বিশ্রামে। ২০২০ সালে করোনার পর থেকেই তিনি এ রকম ঘন ঘন অসুস্থ হচ্ছেন বলে জানান।

মুজিবুলের করোনা ধরা পড়ার পর তাঁর বাসা দামপাড়া এলাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। তাঁর বাসাটি পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীরা গিয়ে সিল করে দিয়েছিলেন। সে সময়ের কথা ভাবলে এখনো বিভীষিকার মতো মনে হয় পরিবারটির কাছে।

মুজিবুল হকের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ছোট মেয়ে মেহেরুন্নেছা সে সময়ের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘আব্বু আগে থেকেই একটু-আধটু অসুস্থ থাকতেন। মার্চের শেষের দিকে ওমরাহ শেষে চট্টগ্রামে ফেরা বড় আপাকে বিমানবন্দরে আনতে যান তিনি। আমরা তাঁকে অনেক নিষেধ করেছিলাম। কারণ, তখন চারদিকে বিধিনিষেধ চলছিল। ওই সময় ইতালির অনেক যাত্রীও আসেন। বিমানবন্দর থেকে ফেরার পর আব্বু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর জ্বর আমাদের ভাবিয়ে তোলে। স্থানীয় বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালের চিকিৎসক শামীম বক্সের কাছে নিয়ে যাই, তখন আব্বু অজ্ঞান। সেখানে চিকিৎসক কোভিড সন্দেহ করেন।’

চিকিৎসক শামীম বক্সের পরামর্শে মুজিবুল হককে ১ এপ্রিল ভর্তি করা হয় করোনার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলে। পরিবারের সদস্যদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ৩ এপ্রিল মুজিবুল হকের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। এরপর শুরু হয় আতঙ্ক। তখন পরিবারের বাকি সদস্যদেরও নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

মেহেরুন্নেছা বলেন, ‘আমাদের তখন খুব একটা ভয় লাগেনি। কারণ, আব্বু আগে থেকেই কমবেশি অসুস্থ। কিন্তু পাড়া–প্রতিবেশীর আচরণ আমাদের বেশি উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা তখন অস্পৃশ্য বস্তু। এমনকি আমাদের নমুনা পরীক্ষার জন্য পিপিই পরে আসা স্বাস্থ্যকর্মী দেখে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে আমাদের আব্বু মারা গেছেন। সে একদিন গেছে। অথচ আমরা প্রতিদিন কয়েকবার আব্বুর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতাম।

এদিকে অজ্ঞান অবস্থায় মুজিবুল হককে জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। পরিবারের লোকজন বাসায় ফিরে দুশ্চিন্তা করছিলেন। তাঁর স্ত্রী রিজিয়া বেগম এবং চার সন্তানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এর কয়েক দিন পর মুজিবুলের ছেলে জাহেদুল হকেরও কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। তাঁকেও ভর্তি করা হয় একই হাসপাতালে। ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তির আগেই অসুস্থ মুজিবুলের জ্ঞান ফিরে আসে।

হাসপাতালের স্মৃতিচারো করে মুজিবুল হক বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তির পর রাত তিনটার দিকে আমার জ্ঞান ফিরে আসে। দেখি আমার কাছে কেউ নেই। দূরে এক নার্স পাহারায় আছেন। পরে আস্তে আস্তে আমার শরীর ভালো লাগতে থাকে। চিকিৎসক আর নার্সরাও নানা পরীক্ষা করে দেখতে থাকেন।’

২৪ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা ও আইসোলেশনে থাকার পর মুজিবুল হক দামপাড়ার বাসায় ফেরেন। ছেলে জাহেদুল হক ফেরেন ২২ দিন পর। করোনাজয়ী দুই সদস্যকে পেয়ে পরিবারের বাকিরা খুশি হন।

এখন মুজিবুল হকের (৬৮) শরীর ঘন ঘন খারাপ হয়। তিনি বলেন, চার–পাঁচ দিন সুস্থ থাকি। আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। চিকিৎসকেরা বলেন যে কোভিডের প্রভাবে এমন হতে পারে।

জানতে চাইলে সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, এখন চট্টগ্রামে কোভিড রোগী নেই। তবে ফ্রন্টলাইনারদের কোভিডের টিকা এখনো দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে যাঁরা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত, তাঁদের কোভিড টিকার চতুর্থ ডোজ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রামে চার বছরে কোভিডে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৭৩ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৭১ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া কোভিডের লক্ষণ নিয়ে আরও প্রায় দ্বিগুণ রোগীর মৃত্যু হয়েছে।