বেপরোয়া কাভার্ড ভ্যান কেড়ে নিল এক গ্রামের তিনজনের প্রাণ, শোকের ছায়া

দুটি অটোরিকশাকে পিষে দিয়ে কাঠবোঝাই একটি পিকআপকেও দুমড়েমুচড়ে দেয় নিয়ন্ত্রণ হারানো কাভার্ড ভ্যানটি। এতে পিকআপ, অটোরিকশার চালকসহ তিনজন নিহত হন। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই উপজেলার সুফিয়া রাস্তার মাথা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

অসুস্থ বাবা, স্ত্রী, চার মেয়ে আর এক ছেলেসহ আটজনের সংসার ছিল ইকবাল হোসেনের (৪৫)। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কেনা একটি পিকআপ চালিয়ে সংসারের ব্যয় চালাতেন তিনি। আজ মঙ্গলবার সকালে বেপরোয়া গতির একটি কাভার্ড ভ্যান তাঁর পিকআপকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। একই দুর্ঘটনায় জীবনপ্রদীপ নিভে যায় ইকবালদের গ্রামের বাসিন্দা মো. ফরিদ (৩৩) ও শহিদুল ইসলামের (৩২)। তাঁদের মৃত্যুতে চট্টগ্রামের মিরসরাই পৌরসভার মধ্যম তালবাড়িয়া গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

আজ সকাল ১০টার দিকে উপজেলার সুফিয়া রাস্তার মাথা এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেনে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মালবাহী একটি কাভার্ড ভ্যান দুটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও কাঠবাহী একটি পিকআপকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনায় মিজানুর রহমান নামের আরও এক ব্যক্তি আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

আজ দুপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তিন ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনেরা মাতম করছেন। বাড়ির উঠানে আহাজারি করছিলেন নিহত ফরিদের মা ছকিনা বেগম। বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, ফুটফুটে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে ফরিদের। সংসারের সুখের জন্য এক বেলা বেকারির মালামাল বিক্রি করে আরেক বেলা অটোরিকশা চালাতেন তাঁর ছেলে। নিজে শত কষ্ট করে সবাইকে সুখে রাখার চেষ্টা করতেন ফরিদ। আজ সব শেষ হয়ে গেল।

একই গ্রামে শহিদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেয়ে সায়মা জান্নাতকে বুকে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী মর্জিনা আক্তার। আহাজারি করতে করতে মেয়েকে তিনি বলছিলেন, ‘আজ থেকে কারে বাপ ডাকবা মা? কে তোমাকে গোসল করাই ভাত খাওয়াইবোরে মা?’

শহিদুলের বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ছয় ভাইয়ের মধ্যে শহিদুল সবার ছোট। ছোট একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে তার। রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাত ভাইটা। সড়ক দুর্ঘটনা আজ ওকে কেড়ে নিল আমাদের কাছ থেকে।’

তিন মাস আগে স্ত্রীকে হারিয়েছেন আজকের দুর্ঘটনায় নিহত ইকবাল হোসেনের বাবা শহিদুল ইসলাম। সেই শোক না কাটতেই হারালেন ছেলেকে। কিছুক্ষণ পরপর হু হু করে কেঁদে উঠছিলেন তিনি। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে বারবার বলছিলেন, ‘এখন কে আমার ওষুধ কিনে আনবে? কাকে বলব আমার দরকারি জিনিসের কথা? সব শেষ, আমার সব শেষ।’

বাড়ির সামনের একটি বাগানে খাটিয়ায় রাখা ইকবালের লাশ ঘিরে তখন জটলা করছিলেন স্বজন-প্রতিবেশীরা।

মিরসরাই পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের মধ্যম তালবাড়িয়া এলাকার কমিশনার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সকালে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার এলাকার তিন ব্যক্তির মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাড়িতে বাড়িতে স্বজন হারানো কান্নার রোল। এমনটা আগে দেখিনি কখনো।’

হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ সকাল ১০টার দিকে সুফিয়া রাস্তার মাথা এলাকায় চট্টগ্রামগামী দ্রুতগতির মালবাহী একটি কাভার্ড ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পূর্ব পাশে থাকা দুটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে পিষে দিয়ে সামনে থাকা কাঠবোঝাই একটি পিকআপে ধাক্কা দেয়। এতে পিকআপটি সড়কের পাশের একটি গাছের সঙ্গে আটকে যায়। পিকআপের চালক ইকবাল হোসেন ও বেকারি পণ্যবাহী অটোরিকশা ভ্যানের চালক মো. ফরিদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। দুর্ঘটনায় আহত শহীদুল ইসলামকে উদ্ধার করে মুমূর্ষু অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে দুপুরে তিনি মারা যান।

জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পর কাভার্ড ভ্যানটি জব্দ করে চালককে আটক করা হয়েছে। চালক চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানোয় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া নিহত দুজনের লাশ তাঁদের পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।