নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১১ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছিল।

মাদার বখ্শ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ
ছবি: প্রথম আলো

পড়াশোনা এক বিষয়ে, শিক্ষক হয়েছেন অন্য বিষয়ে। পরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সনদ বা প্রশিক্ষণও নেননি। এমন অভিযোগ রাজশাহীর মাদার বখ্শ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের দুজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তাঁরা শিক্ষকতা করছেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ও গ্রন্থাগারিকের বিরুদ্ধেও বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১১ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে এত বছরেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটিতে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে ১৯৯৬ সালের ৬ জুন যোগ দেন এস এম খাইরুল কবীর। ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ এমপিওভুক্তি হয় তাঁর। ২০১১ সালের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর এই শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাই করে জানায়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা নেই তাঁর। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন প্রাণরসায়নে। প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁর নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি।

এই শিক্ষকদের নিয়োগের বিষয়ে কলেজের সে সময়ের কর্তৃপক্ষ এবং নিয়োগ কর্তৃপক্ষ দায়ী। আর মানবিক কারণে ওই শিক্ষকদের বাদ দেওয়া যায়নি
সালমা শাহাদাত, অধ্যক্ষ

১৯৯৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৯ লাখের বেশি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে। এমনকি তাঁর এমপিও স্থগিতের সুপারিশ করা হয়। সেই খাইরুল কবীর পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে শিক্ষকতা করছেন এখন।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে খাইরুল কবীর বলেন, ওই সময়ে নিয়োগ বোর্ড কোনো শর্ত দেয়নি যে এভাবে নিয়োগ পেতে হবে। তখন কোনো শর্তও ছিল না।

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল মতিন ও সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক এনামুল হক ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর মাদার বখ্শ্‌ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজটি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করেন। পরে ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁরা নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়ে এটি বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করেন। বিষয়টি এত দিনে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সহকারী সচিব (অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শাখা) সেলিম সিকদার।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক ও কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল জলিল প্রথম আলোকে বলেন, ওই কলেজ নিয়ে একটি অডিট রিপোর্ট ছিল। ওই প্রতিবেদনের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে চলতি বছরের মার্চে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে কলেজটির গভর্নিং বডির সভায় আলোচনা হয়। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও শিক্ষক প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান। সভায় তিনি ২০১১ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনও জমা দেন। পরবর্তী সভায় অভিযুক্ত শিক্ষকদের চাকরিসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক। সর্বশেষ গত ১৬ আগস্ট গভর্নিং বডির সভায় তিনি এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।

কম্পিউটার বিষয়ের প্রভাষক সঞ্জয় কুমারের বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি নিয়োগ পান ১৯৯৬ সালে। নিয়োগ লাভের পর ১৯৯৭ সালে তিন মাসের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বিধি অনুযায়ী, তাঁর চাকরির আবেদনপত্র বাছাইয়েই বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু আবেদন বাতিল না করে তাঁকেই নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কারণে সরকারি বেতন-ভাতা বাবদ পাওয়া আট লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে।

তবে সঞ্জয় কুমারের দাবি, তিনি যে সময়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন, তখন কম্পিউটার বিষয়ে ডিপ্লোমাধারী কেউ ছিল না। ওই সময়ে

এভাবেই নিয়োগ হয়েছে। পরে তিনি এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কলেজের অধ্যক্ষ সালমা শাহাদাতের বিষয়ে বলা হয়, তিনি কলেজটিতে ২০০৭ সালে অধ্যক্ষ হন। এর আগে ২০০৩ সালে তিনি উপাধ্যক্ষ হন। নিরীক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে সালমা উপাধ্যক্ষ পদে পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতাসংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তখন তাঁর শিক্ষকতার বয়স ছিল ৯ বছর ৯ মাস ১৫ দিন। অথচ উপাধ্যক্ষ হওয়ার জন্য দরকার ছিল ১২ বছরের অভিজ্ঞতা।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার পর ২০১১ সালে এ নিয়ে গভর্নিং বডির সভা হয়েছিল বলে জানান অধ্যক্ষ সালমা শাহাদাত। তিনি বলেন, এই শিক্ষকদের নিয়োগের বিষয়ে কলেজের সে সময়ের কর্তৃপক্ষ এবং নিয়োগ কর্তৃপক্ষ দায়ী। আর মানবিক কারণে এই শিক্ষকদের কলেজ থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে যেহেতু তদন্ত কমিটি হয়েছে, তাই কমিটিই সবকিছু দেখবে।

গ্রন্থাগারিক হাসিবা খাতুনের বিষয়ে বলা হয়, ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি যোগদান করেন এবং সে বছর ১ ডিসেম্বর তিনি এমপিওভুক্ত হন। এমপিওভুক্তির সময়ে কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ছিল না তাঁর। তিনি গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৯৫ সালে। এ কারণে ডিপ্লোমা অর্জন করার আগের বেতন–ভাতা হিসেবে নেওয়া ৮৩ হাজার ৩৬০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়। হাসিবার দাবি, তিনি পরে গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে ডিপ্লমা ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আর অডিটে আপত্তি তোলা টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেছেন।

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সহকারী সচিব (অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা শাখা) মো. সেলিম সিকদার বলেন, নিরীক্ষা অধিদপ্তর কী ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছে, তার সত্যতা যাচাই করার জন্য উভয় পক্ষ বসে আলোচনা হয়। পরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের বিষয় এত দিনে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা।

নিরীক্ষার বিষয়ে জবাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল কি না, এ বিষয়ে অধ্যক্ষ সালমা শাহাদাত বলেন, এ বিষয়ে বোধ হয় এত কথা না বলাই ভালো। তদন্ত চলছে।