পানিসংকটে উচ্ছেদের ঝুঁকিতে চিম্বুকের অর্ধেক পাড়া

আড়াই হাজার ফুট নিচ থেকে মটরের সাহায্যে পানি তোলা হচ্ছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় বান্দরবানের চিম্বুক এলাকা থেকে তোলামংহাইসিং মারমা।

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ক্রমবর্ধমান পানির সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া না হলে আগামী ২০ বছরে এই পাহাড়ের অর্ধেক পাড়া উচ্ছেদের মুখে পড়বে। এই এলাকার ঝিরি-ঝরনা যেভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন উন্নয়নকর্মী ও পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দারা। জেলার মধ্যে চিম্বুক পাহাড়ে পানির সংকটের তীব্রতা যে সবচেয়ে বেশি, বিষয়টি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরাও স্বীকার করেছেন।

বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের ম্রোলংপাড়া থেকে জীবননগর পর্যন্ত ৩৩টি পাড়ায় প্রায় এক হাজার ম্রো পরিবারের বসবাস রয়েছে, জানালেন দক্ষিণ হাঙ্গর মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) পারিং ম্রো। তাঁর মতে, চিম্বুক পাহাড়ে প্রধানত ম্রোরাই বসবাস করে। আর সব কটি ম্রোপাড়ায় পানির সংকট প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। পরিকল্পিত উপায়ে সংকটের টেকসই মোকাবিলা করা না গেলে ৩৩টি পাড়ার প্রায় অর্ধেকই উচ্ছেদের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন চিম্বুকবাসী।

চিম্বুক পাহাড়ে বিএনকেএস নামে একটি উন্নয়ন সংস্থায় দীর্ঘদিন কাজ করেন সিংচং ম্রো। তিনি জানালেন, ২০ বছর আগেও চিম্বুক পাহাড়ে পানির কিছু সমস্যা ছিল, কিন্তু সংকট ছিল না। গত ২০ বছরে ক্রমে বেড়ে যাওয়া সমস্যা বর্তমানে গভীর সংকটে পরিণত হয়েছে। আগামী ২০ বছরে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। চিম্বুকের ৩৩টি পাড়ার অন্তত ১৫টি একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়বে। ওই সব পাড়ায় কোনো পানি পাওয়া যাবে না। পানি না পেয়ে পাড়াগুলো উচ্ছেদ হয়ে যাবে।

কেন পানির সংকট তীব্রতর হচ্ছে, জানতে চাইলে সিংচং ম্রো বলেন, ২০০৪-০৫ সাল থেকে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রোরা জুমচাষ ত্যাগ করে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড় করে ফলের বাগান করা শুরু করেছেন। একমাত্র প্রাকৃতিক বনাঞ্চলই পাহাড়ের পানি ধরে রাখতে পারে। এ জন্য বাগানের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পানির সংকটের তীব্রতাও বাড়ছে। এ ছাড়া কাঠ ব্যবসার নামে স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে প্রাকৃতিক মাতৃগাছের বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে।

চিম্বুক পাহাড়ের গ্যেৎসেমানিপাড়া থেকে ম্রোলংপাড়া হয়ে পাবলা হেডম্যানপাড়া পর্যন্ত গিয়ে পানির তীব্র সংকটে চরম ভোগান্তির চিত্র দেখা গেছে। চিম্বুক বাগানপাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) পাইয়া ম্রো বলেছেন, মার্চ থেকে ১ হাজার লিটার পানি ৮০০ টাকায় কিনে দিন যাপন করছেন। গত সপ্তাহে বৃষ্টি হওয়ায় দুর্ভোগ কিছুটা কমেছে। সবাই আরও বৃষ্টির অপেক্ষায় রয়েছেন। পিঠে বাচ্চা ঝুলিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়া পাইপ থেকে পানি সংগ্রহ করতে আসা নারী কমক্রুম ম্রো বললেন, পানির ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি নারীদের। পাহাড়ের পাদদেশের ঝিরি-ঝরনা থেকে পানি সংগ্রহ করতে দিনের অর্ধেক সময় ও শারীরিক শক্তির সবটা শেষ হয়ে যায়।

পানি সরবরাহের জন্য ১ হাজার ৫০০ ফুট পাহাড়ের নিচ থেকে পাইপের সাহায্যে এই ট্যাংকে পানি তুলে পাড়াবাসীকে সরবরাহ করা হয়। গতকাল সকাল নয়টায় বান্দরবানের চিম্বুক পাবলা হেডম্যানপাড়ায়
মংহাইসিং মারমা

পাবলা হেডম্যানপাড়ার ৮৫ বছরের প্রবীণ মেনতন ম্রো জানিয়েছেন, আগে পানির কোনো সমস্যা ছিল না। এখন জনসংখ্যা বাড়ছে, মানুষ বাগান করছেন, বাগানেও পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিকে পানির চাহিদা বাড়ছে, অপর দিকে পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। সরকারিভাবে সংকট নিরসন ও পানির উৎসের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষার উদ্যোগ না নিলে টেকসই সমাধান হবে না। আর সংকট বৃদ্ধি থামানো না গেলে পাড়াগুলো রক্ষা করা যাবে না বলে বৃদ্ধ মেনতন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।

চিম্বুক পাহাড়ের পানির সংকট বাড়ার পেছনে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পরিকল্পনাহীনতা রয়েছে বলে মনে করেন মোহাম্মদ মহসিন। তিনি আইডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে আড়াই হাজার ফুট পাহাড়ের নিচ থেকে পানি তুলে চিম্বুক পাহাড়ের বিভিন্ন পাড়ায় সরবরাহের কাজ করেন। তাঁর মতে, পাহাড়ের কয়েকটি উঁচু চূড়ার পয়েন্ট নির্ধারণ করে পানি সংরক্ষণাগার (ট্যাংক) নির্মাণ করতে হবে।

পানি সঙ্কটে উচ্ছেদের ঝুঁকিতে পড়েছে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের অর্ধেক পাড়ার বাসিন্দা। চিম্বুক পাহাড়ের
ফাইল ছবি।

সৌরবিদ্যুতে চালিত মোটরে উৎস থেকে ওই সংরক্ষণাগারের পানি তুলে পাইপলাইনে ছেড়ে দিলে পাড়াগুলোতে খুব সহজে পর্যাপ্ত সরবরাহ করা যায়। এমনকি চিম্বুক পাহাড়ের বাগানিরাও বাগানে পানি ব্যবহার করতে পারবেন। এটি পানির সংকট নিরসনের টেকসই ব্যবস্থা হতে পারে, কিন্তু এ জন্য দরকার লাগসই পরিকল্পনা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী জুলহাস মিয়া বলেছেন, চিম্বুক পাহাড়ে ঝিরি-ঝরনার ভূ-উপরিস্থ পানি ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যায় না। ঝিরি-ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তবে জেলার পানিসংকট নিরসনে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ২০২৮ সালে জেলায় পানির সংকট থাকবে না।