পরিবেশকর্মীর সাক্ষাৎকার

গাজীপুরে তুরাগ নদে দূষণের উৎস ২৯৬টি আর লবণদহে ১৪৫টি

গাজীপুরে ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বংশী, বালু, বানার, গারগারা ও চিলাই নদ–নদীর পাশাপাশি আছে অনেকগুলো বিল। এসব নদ-নদী ও বিলে একসময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু শিল্পকারখানার বর্জ্যের কারণে কমেছে দেশীয় মাছ। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের প্রতিষ্ঠাতা ও রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেনের সঙ্গে।

প্রশ্ন:

গাজীপুরে কতটি পয়েন্টে দূষণ হয় বলে আপনি চিহ্নিত করেছেন?

মনির হোসেন: আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী গাজীপুরে ১৯টি নদী আছে। তুরাগ, চিলাই, লবণদহ, বালু, শীতলক্ষ্যা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, খিরো, পারুলী, সুতী, বানার, নাগদা, লৌহজং, বংশী, সালদহ, সুতিয়া, গোল্লার, নালজুড়ি, কনাই ও টঙ্গী নদী। এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এর মধ্যে তুরাগ, লবণদহ, চিলাই ও বংশী বেশি দূষিত। আমরা তুরাগ নদে প্রায় ২৯৬টি দূষণের উৎস পেয়েছি, লবণদহে ১৪৫টি আর চিলাই নদে ৫৬টি। দূষণ পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে কারখানা, বাজার ও গৃহস্থালির বর্জ্যসহ পয়োনালি।

প্রশ্ন:

নদী রক্ষা করা কেন বর্তমানে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে?

মনির হোসেন: নদী জাতীয় সম্পদ। আর নদীর সংকট মানেই জাতীয় সংকট। এ সংকট উত্তরণের জন্য সবাইকে একযোগে মাঠে নামতে হবে। কারণ, নদীই এ দেশের প্রাণ। নদীর জলপ্রবাহের সঙ্গে আমাদের জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

নদীর গতিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

মনির হোসেন: দখল-দূষণমুক্ত ও প্রবহমান নদীই সুস্থ নদী। যে নদীর প্রবাহ নেই, তা সুস্থ নদী নয়। নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সেটিকে দখল মুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পোর্ট আইন-১৯০৮ ও বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ অনুসারে তীর চিহ্নিত করে সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি।

প্রশ্ন:

নদী কেন স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ হারিয়েছে?

মনির হোসেন: অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বালু উত্তোলন ও অবহেলিত নদী ব্যবস্থাপনার কারণে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদ-নদীর তীরভূমি ও বন্যাপ্রবণ অঞ্চলকে রক্ষা করতে না পারলে নদীর প্রবাহ ধরে রাখা যাবে না। শিল্পাঞ্চল এলাকায় গত ২০ বছরের তীরভূমি চিহ্নিত করলে দেখা যাবে, অনেক জায়গায় ১০০ ফুট পর্যন্ত নদীর জায়গা নিজের করে নিয়েছে কারখানাগুলো। এমন অবস্থায় সুতাকৃমির মতো শুধু নদীর লম্বাটে রূপটাই আমরা দেখছি। প্রস্থটা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন:

নদীর দূষণ রোধে কী করা যায়?

মনির হোসেন: আমরা শিল্পকারখানা বন্ধ করতে বলিনি। আমরা পরিবেশ ও নদীবান্ধব শিল্পপ্রতিষ্ঠান চাই। আমি নগরায়ণের বিপক্ষে নই, আমি ন্যায্য নগর চাই। গ্রামের চেয়ে শহরে তুলনামূলকভাবে সচেতন মানুষ বসবাস করেন। আর সেই সচেতন মানুষেরাই সুচতুরভাবে নদীদূষণ করেন।

নদীদূষণের জন্য শিল্পকারখানার পাশাপাশি নাগরিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদও দায়ী। সিটি করপোরেশন থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত সব বর্জ্য নদী ও খোলা জায়গায় ফেলা বন্ধ করতে হবে এবং আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। শিল্পকারখানায় যেমন ইটিপি স্থাপন করা কমপ্লায়েন্সের অংশ, তেমনি স্থানীয় সরকারের এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পয়োনালিতে এসটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

নদী রক্ষায় প্রশাসনের ভূমিকা মুখ্য। আমি, আপনি সংকটের জায়গাগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারব। তবে এ ধরনের অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা প্রশাসনের কাজ। আমাদের দেশে নদী রক্ষায় ডজনখানেক আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ আশানুরূপ হচ্ছে না। নদী অধিকারকর্মী ও নদীর পাড়ের মানুষকে নিয়ে জনমত গঠনসহ সচেতনতামূলক প্রচারণা করতে পারে প্রশাসন। এতে আইন প্রয়োগকালে সাধারণ জনগণের সমর্থন পাবে প্রশাসন।

প্রশ্ন:

পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়মুক্তির মতো আচরণ কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

মনির হোসেন: পরিবেশ অধিদপ্তরের মূল সংকট হচ্ছে জনবল। গাজীপুরের মতো একটি বৃহৎ শিল্পাঞ্চলের জন্য উপপরিচালকের কার্যালয় নিতান্তই অপ্রতুল। এখানে একটি পরিচালকের কার্যালয় স্থাপন করা জরুরি। পরিচালকের কার্যালয় স্থাপিত হলে এখানে তিন থেকে চারজন উপপরিচালক, ১০-১২ জন সহকারী পরিচালক ও তার দ্বিগুণ পরিদর্শক থাকবেন। নিজস্ব এনফোর্সমেন্ট ও ল্যাব থাকবে। তখন হয়তো দায়মুক্তির আচরণ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।