চাকরি চুয়াডাঙ্গায়, একজন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে, আরেকজন ঢাকায়
প্রধান শিক্ষক নিগার সুলতানা ও সহকারী শিক্ষক নিনা শাহরিয়ারের কর্মক্ষেত্র চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার হাজরাহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু এই বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই তাঁদের চোখে দেখেনি। এমনকি অনেকে তাঁদের নামও শোনেনি। বিদ্যালয়টির প্রাক্–প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে।
অভিভাবকেরা জানান, দুই শিক্ষকের দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পাঠদান দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পদ শূন্য ঘোষণা না করায় সেখানে নতুন করে শিক্ষকের পদায়ন করা হচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এ টি এম শামিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান শিক্ষক নিগার সুলতানা দীর্ঘদিন ধরে স্বজনদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। আর সহকারী শিক্ষক নিনা শাহরিয়ার পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন রাজধানী শহর ঢাকায়। তাঁদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি আত্মীয়স্বজনেরাও কোনো তথ্য দেন না।
সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুণ্ডু অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের মাসের পর মাস ধরে অনুমোদনহীন (ছুটি ছাড়া) কর্মস্থলে অনুপস্থিতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তাঁদের বেতন-ভাতা স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১ জুলাই নিগার সুলতানা হাজরহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। চার বছর ধরে তিনি নিজের খেয়ালখুশিমতো যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসাসহ বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছেন। ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের চিকিৎসাজনিত ছুটির একটি দরখাস্ত নিজ বিদ্যালয়ে রেখে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তিনি। অথচ এ ধরনের ছুটির জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দেশে না এসেই ২০১৯ সালের ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত আরও দুই মাসের জন্য চিকিৎসাজনিত ছুটির একটি দরখাস্ত উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠান নিগার। ২ বছর ৯ মাস ৮ দিন অননুমোদিত ছুটি কাটিয়ে ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি বিদ্যালয়ে যোগ দেন। এরপর ৩ মাস ৭ দিন বিদ্যালয়ে গেলেও চলতি বছরের ২৮ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন তিনি।
নিগার সুলতানা হাজরহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। চার বছর ধরে তিনি নিজের খেয়ালখুশিমতো যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া-আসাসহ বিভিন্ন অজুহাতে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছেন।
নিগার সুলতানার বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুণ্ডু ১৫ জুন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জানান। তাতে উল্লেখ করা হয়, নিগার সুলতানা এর আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি বা অবহিতকরণ ছাড়াই বিদেশ (যুক্তরাষ্ট্র) যান এবং সেখানে অবস্থান করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিভাগীয় মামলায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ৪-এর উপবিধি (২) (ঘ) ধারা অনুযায়ী বিভাগীয় উপপরিচালক গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর তাঁর বেতন গ্রেড নিম্নতর ধাপে অবনমিত করে প্রারম্ভিক ধাপে নির্ধারণ করে দেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অসুস্থ মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর দরখাস্ত করলে শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের জন্য শর্তসাপেক্ষে ছুটি মঞ্জুর করা হয়।
শর্তানুযায়ী চলতি বছরের ২৭ মে কর্মস্থলে যোগদান করা, ছুটির মেয়াদ কোনোক্রমেই বর্ধিত না করা এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যোগদান করতে ব্যর্থ হলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু নিগার সুলতানা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সব নির্দেশনা অবজ্ঞা করে এখনো যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
সহকারী শিক্ষক নিনা শাহরিয়ার ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ বছর ৬ মাস কোনো প্রকার ছুটি ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত রয়েছেন। সহকর্মী শিক্ষকদের ভাষ্যমতে, নিনা শাহরিয়ার বর্তমানে ঢাকায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে বসবাস করছেন।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম কুমার কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, নিনা শাহরিয়ারের বাসার ঠিকানায় গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। অননুমোদিত ছুটির বিষয়ে ২০২০ সালের ১৪ জুলাই কৈফিয়ত তলব করা হলেও অদ্যাবধি তার জবাব দেননি। মুঠোফোন নম্বর পরিবর্তন করায় কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকেও একাধিকবার নিগার সুলতানা ও নিনা শাহরিয়ারের পরিবারের সঙ্গে এবং মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।