মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে স্বয়ং ‘দেবতারা’ খনন করেছিলেন যে পুকুর

খাগড়াছড়ির নুনছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায় হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত দেবতা পুকুরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন পর্যটকেরা। সম্প্রতি তোলাপ্রথম আলো

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে একটি ত্রিপুরাপাড়া। পাড়ার একপাশে পাহাড়ি ঝরনা, অন্য পাশে সিঁড়ি। ছায়াঘেরা পথ ধরে সিঁড়ির ১ হাজার ৪৮১টি ধাপ পেরিয়ে ওপরে ওঠার পর দেখা মেলে স্বচ্ছ পানির একটি পুকুর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই পুকুরকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন মাতাই পুখিরি। ত্রিপুরা ভাষায় মাতাই পুখিরি অর্থ দেবতা পুকুর। সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, স্থানীয় বাসিন্দাদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই পুকুর খনন করেছেন স্বয়ং দেবতা।

পুকুরটি অবস্থিত খাগড়াছড়ি জেলার নুনছড়ি এলাকায়। জেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কের মাইচছড়ি। সেখান থেকে চার কিলোমিটার দূরে নুনছড়ির ত্রিপুরা পাড়াটি অবস্থিত। সেখান থেকে সিঁড়ি বেয়ে পুকুরটিতে যাওয়ার পথে দেখা যাবে সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে মেঘ-পাহাড়ের মিতালি। ঝরনার পানির শব্দ আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে শুনতে ওপরে ওঠার পথে একাধিক স্থানে দেখা মেলে বিশ্রামাগারের। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে সময় লাগে ৪০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা। পাঁচ একরের পুকুরটির পাশে বটসহ নানা ধরনের গাছ। পূজারিদের জন্য রয়েছে একটি শিবমন্দির।

প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিতে মাতাই পুখিরি এলাকায় বসে মেলা। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন পূজা দিতে আসেন। পূজারিরা দেবতা পুকুরে গোসল করে পাশের শিবমন্দিরে পূজা দেন। স্থানীয় ত্রিপুরাদের বিশ্বাস, এখানে পূজা দিলে পূরণ হয় সব মনোবাসনা। পুকুরটি নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে নানা উপকথা।

স্থানীয় বৃদ্ধ গোলক কুমার (৮২) ত্রিপুরা বলেন, ছোটবেলায় তিনি তাঁর দাদার মুখে শুনেছিলেন, পাহাড়ের চূড়ায় দুপাশে দুটি পাড়া ছিল একসময়। পাড়ার একজন জুমিয়া জুম চাষ করতেন। একপর্যায়ে ওই জুমিয়া (জুমচাষি) স্বপ্নে দেখলেন, তাঁকে পাহাড়ে জুমচাষ করতে নিষেধ করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি স্বপ্নকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিবছর জুমচাষ করতে থাকলেন। জুমিয়া এতে বিশ্বাস করেননি। পরবর্তী সময়ে কোনো এক অমাবস্যার রাতে এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়। পরদিন সকালে দুই পাড়ার লোকজন দেখেন, জুমিয়া যেখানে জুম করতেন, সেখানে একটি বিশাল পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে।

দেবতা পুকুরে ওঠার সিঁড়ি। খাগড়াছড়ির নুনছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায়
প্রথম আলো

খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কে মাইচছড়ির অবস্থান। মাইচছড়ি থেকে আরও চার কিলোমিটার দূরে নুনছড়ি মৌজায় দেবতা পুকুর। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় ত্রিপুরাপাড়ায়। সেখানে গাড়ি রাখতে হয়। ত্রিপুরাপাড়াটাও ছবির মতো সুন্দর। ছোট ছোট মাটির ঘরসহ আছে মাচান ঘর।

পাড়ার একপাশে পাহাড়ি ঝরনা আর এক পাশে পুকুরে যাওয়ার গাছপালার ছায়াঘেরা সিঁড়ি। ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দেখা মিলবে দেবতা পুকুরের। ঝরনা আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে শুনতে সবুজ পাহাড়ের ভাঁজে মেঘ–পাহাড়ের মিতালিও দেখা যাবে এখানে এলে। এমন নিসর্গের টানে প্রতিবছরই দেবতা পুকুরে হাজির হন শত শত পর্যটক।