কত দিন মানুষ সহ্য করবে?

ফুটপাতে দোকান। সড়কের ওপর ছাতা দিয়ে বসেছে দোকান। এতে পথচারীদের ঝুঁকি নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে সড়কে। সবসময় লেগে থাকে যানজট। চট্টগ্রাম নগরের জহুর হর্কাস মার্কেটের সামনেছবি: জুয়েল শীল

মঙ্গলবার বেলা ১১টা। চট্টগ্রাম শহরের কে সি দে সড়কে অবস্থিত সিনেমা প্যালেস থেকে নিউমার্কেট যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করেছি। আগে শহীদ মিনার আর পাবলিক লাইব্রেরির মাঝখানের সড়ক দিয়ে হুট করে চলে যাওয়া যেত। সেই পথ বহু বছর ধরে বন্ধ নতুন করে নির্মাণাধীন গ্রন্থাগার ও মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনটির জন্য। একটি স্থাপনা নতুন করে নির্মাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক কত দিন বন্ধ থাকতে পারে? ওই পথ দিয়ে যেতে যেতে মনে প্রশ্ন আসে।

ট্রাফিক কিংবা অন্য কোনো আইনে এর হয়তো কোনো উল্লেখ নেই। তাই বছরের পর বছর ধরে এই সড়ক বন্ধ রয়েছে, কারও কোনো কিছু বলার নেই, করার নেই। যা-ই হোক, আমি ঘুরপথে টেলিফোন অফিস, শতাব্দীপ্রাচীন বোস ব্রাদার্সের মোড় পেরিয়ে পাহাড়ি ঢালু রাস্তা ধরে এগিয়ে যাই। পেছন থেকে দ্রুতগতিতে গাড়ি নামছে। আর আমার বুক ধড়ফড় করছে। কারণ, এই সড়কে ফুটপাত নেই। কোনো রকমে পথটি পেরিয়ে থিয়েটার ইনস্টিটিউট ও রাইফেল ক্লাবের সামনে এসে পৌঁছালাম। এখানে ফুটপাত আছে, কিন্তু হাঁটার উপায় নেই। পুরো ফুটপাতে বসেছে নানা রকমের দোকান।

সামান্য এগিয়ে অপর্ণাচরণের মোড়ে অনেক গাড়ি এলোমেলো অবস্থায় একজন আরেকজনকে এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ওখানে তিনটি রাস্তা তিন দিক থেকে এসেছে। সব দিক থেকে যানবাহন এসে জটলা পাকিয়েছে। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। কয়েক গজ দূরে অপর্ণাচরণের সামনে যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি টেম্পো। যাঁরা পায়ে হাঁটছেন, তাঁদের পা চলছে না। আর যাঁরা যানবাহনে, চাকা চলছে না। কোনো রকমে মানুষের ধাক্কা খেয়ে রিকশা, অটোরিকশার গা ঘেঁষে আপনি সামনে যেতে চাইছেন, কিন্তু পারবেন না। দুই মিনিটের হাঁটাপথও আপনার জন্য অনিশ্চিত।

রেয়াজউদ্দীন বাজার, নিউমার্কেট এলাকার চৌরাস্তার মোড়, তিনপুলের মাথা, স্টেশনরোডে চলছে এক ভয়াবহ অরাজকতা। এখানে ফুটপাত দখলে, সড়কও দখলে, যেদিকে চোখ যায়, শুধু দোকান আর দোকান। যেন নিত্য এক মেলা চলছে। সড়কের মাঝখানে কাপড়ের দোকান, খাবারের দোকান, তৈজসপত্রের দোকান, ফলের দোকান। আরও কত কি!

শুধু নিউমার্কেট এলাকা নয়; চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ রাস্তা, ফুটপাত ও যানবাহন চলাচলের বিশৃঙ্খল অবস্থা এখন চরমে পৌঁছেছে। ঘর থেকে বেরোলেই প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছে। মানুষের ধৈর্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে এক অচলায়তন। বিশেষ করে নগরের স্কুল-কলেজগুলো শুরু ও ছুটির সময় পুরো নগর যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। নগরের শান্ততম পাহাড়ি রাস্তা হলো সারসন রোড। এটিও স্কুলের অপেক্ষমাণ গাড়ির দীর্ঘ লাইনের কারণে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ থাকে। জামাল খান মোড়েরও একই অবস্থা। এ রকম স্থান ও জায়গার নাম উল্লেখ করে শেষ করা যাবে না। কারণ, পুরো নগরের ৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকার বেশির ভাগের অবস্থা এমন। এটাই যেন স্থায়ী একটা ব্যবস্থা।

ফুটপাত আর রাস্তা দখল, স্কুল ও বিপণিকেন্দ্রগুলোর সামনে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি পার্কিং, ব্যাটারি রিকশার নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল, অত্যধিক রিকশার কারণে চট্টগ্রামের যানজট নিরসনের কোনো উদ্যোগ সফল হচ্ছে না। ব্যর্থ হচ্ছে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প। যানজট নিরসনের লক্ষ্যে বহাদ্দার হাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়কে দুটি ওভার পাস হয়েছে, বেশ কয়েকটি উড়ালসড়ক হয়েছে।

সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, কাপাসগোলা সড়ক, আন্দরকিল্লার জেনারেল হাসপাতালের সামনে থেকে লালদীঘির উত্তর পাড় পর্যন্ত ২০০ মিটার রাস্তা ৫ কোটি টাকা খরচ করে সম্প্রসারণ করা হয়। অলংকার মোড় থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কের উন্নয়ন হয়েছে। কদমতলী-পাঠানটুলী সড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। গত কয়েক দশকে বিকল্প হাইওয়ে হয়েছে, অনেক সড়ক প্রশস্ত হয়েছে, ফ্লাইওভার হয়েছে।

বলতে গেলে, নগরের ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু এসব কাজের কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম শহরের অনেক ব্যস্ত রাস্তায় সড়কের ওপর গাড়ির ডাবল পার্কিং লাইন চোখে পড়ে নিত্য। কোনো কোনো ফুটপাত আর সড়কে দেখা যায় দীর্ঘ ভ্যানের সারি। বেশির ভাগ ফুটপাতে দোকানের পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়। ভ্রাম্যমাণ হকাররা রাস্তার মাঝখানে আরামে দোকানদারি করেন। এমন অবস্থার মধ্যে কিছু কিছু সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আন্দরকিল্লা থেকে নন্দনকাননে আসার রাস্তা নজির আহমদ চৌধুরী সড়ক। দুই পাহাড়ের মাঝখানে এই রাস্তাকে বন্ধ করে ভুতুড়ে রাস্তায় পরিণত করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে, তা-ও কারও জানা নেই। শুধু যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে এমন নৈরাজ্য আর অরাজক পরিস্থিতি চলছে। এই অবস্থা কত দিন চলবে? কত দিন মানুষ সহ্য করবে?