‘আমরা ওদের ধাওয়া করছিলাম আর ওরা পালিয়ে যাচ্ছিল’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই মুক্ত হয়েছিল কিছু অঞ্চল। কেমন ছিল সেসব অঞ্চলের পরিবেশ, মানুষের আবেগ-অনুভূতি। সেই সময়ের চিত্র।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে নির্মিত তেলিখালী স্মৃতিসৌধছবি : সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহ ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগেই একে একে মুক্ত হতে থাকে জেলার বিভিন্ন এলাকা। আনন্দ–উল্লাসে বিজয়ের আনন্দ উদ্‌যাপন করে মানুষ।

ময়মনসিংহের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল। তিনি হালুয়াঘাটে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩ ডিসেম্বর থেকে মিত্র বাহিনী ময়মনসিংহ অঞ্চলে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশে ঢোকে হালুয়াঘাটের সূর্যপুর এলাকা দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে তারা ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। সীমান্ত এলাকায় শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। একপর্যায়ে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। ৭ ডিসেম্বর হালুয়াঘাট মুক্ত হয়।

হালুয়াঘাট মুক্ত হওয়ার কথা স্মরণ করে ধোবাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, হালুয়াঘাটের সূর্যপুরের পাশাপাশি গোবরাকুড়া, কড়ইতলী, আয়নাতলী এলাকা থেকেও যৌথ বাহিনী আক্রমণ চালায়। রাতভর যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে। ৭ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে হালুয়াঘাট সদরে চলে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। 

মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের খবর দ্রুত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এতে গ্রামের সব শ্রেণি–পেশার মানুষ আনন্দ–উল্লাস করে হালুয়াঘাট উপজেলা শহরে এসে মিছিল করে। বিজয় উদ্‌যাপন করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদির বলেন, ‘আমরা ওদের ধাওয়া করছিলাম আর ওরা পালিয়ে যাচ্ছিল।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় ধোবাউড়া উপজেলা ছিল না বলে জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদির। তিনি বলেন, দুর্গাপুরের চারটি, হালুয়াঘাটের দুটি ও পূর্বধলার একটি ইউনিয়ন নিয়ে ধোবাউড়া উপজেলা গঠিত হয়। চারটি উপজেলা যেহেতু দুর্গাপুরের, সে কারণে এবং দুর্গাপুর উপজেলা ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীমুক্ত হওয়ায় সে দিনটিকেই ধোবাউড়ার মুক্তি দিবস হিসেবে ধরা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ–বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ১১) ও আগামী প্রকাশনী প্রকাশিত একাত্তরের বিজয়গাথা বইয়ের তথ্য, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, ফুলবাড়িয়া ও ভালুকা মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর; ফুলপুর, তারাকান্দা, ঈশ্বরগঞ্জ, ত্রিশাল ও গফরগাঁও ৯ ডিসেম্বর; সদর ও মুক্তাগাছা মুক্ত হয় ১০ ডিসেম্বর, নান্দাইল মুক্ত হয় ১১ ডিসেম্বর।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘হালুয়াঘাট থেকে ফুলপুরের সরচাপুর কংশ নদের ঘাটে এসে ঘাঁটি গাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমরা শুনতে পাই, তারা সেখানে আছে। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণ করি। ৮ ডিসেম্বর সরচারপুর ঘাটে যৌথ বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ হয়। দিনভর থেমে থেমে যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যার পর পাকিস্তানিরা পালিয়ে গেলে ৯ ডিসেম্বর বিজয়ের বেশে মুক্তিযোদ্ধারা ফুলপুরে প্রবেশ করে।’

মৈত্রী প্রিন্টার্স প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে মুক্তাগাছা বইয়ে মুর্শেদ আলম খান ও এম ইদ্রিস আলী লিখেছেন, ডিসেম্বরের প্রথম দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর পিছু হটার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। মুক্তাগাছার মানুষও মুক্তির প্রহর গুনতে থাকেন। তারাকান্দার গোপালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ৯ ডিসেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয়। পরে ওই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে ময়মনসিংহ শহরে চলে যায়।

১০ ডিসেম্বর সকালে খবর পাওয়া যায়, ময়মনসিংহ শহর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তাগাছা হয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরের দিকে পালিয়ে গেছে। সেখান থেকে তারা ঢাকার দিকে চলে যেতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর মুক্তাগাছা ও ময়মনসিংহ সদর মুক্ত হয়। শহরের পাড়া–মহল্লায় আনন্দ করে মানুষ। 

জেলার মধ্যে সব শেষে মুক্ত হয় নান্দাইল উপজেলা। নান্দাইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মাজহারুল হক ফকির বলেন, ‘১৭ নভেম্বর রাত সাড়ে তিনটার দিকে ১৭৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে তিনটি দল থানা আক্রমণ করি। আমি ছিলাম একটি অংশের কমান্ডার। যুদ্ধ চলতে থাকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত। এর মধ্যে ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্তানি একটি টিম নান্দাইল গিয়ে যুক্ত হলে আমরা টিকতে না পেরে পিছু হটি। এতে আমাদের দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আর পাকিস্তানিরা এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হত্যা করা হয় তিনজন নিরীহ মানুষকে।’ এ ঘটনা মাথায় রেখে পরে ১০ ডিসেম্বর ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণের প্রস্তুতি নিলে খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর ভোরে তাঁরা থানা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। বিজয়ের মিছিল শুরু হয় চারদিকে।