রংপুরের কারমাইকেল কলেজে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ চালু করা হয় ২০১০ সালে। বর্তমানে এই বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২৮। তবে বিভাগের তিন শিক্ষকের পদের বিপরীতে আছেন দুজন। শিক্ষকসংকটের একই চিত্র মার্কেটিং, সমাজবিজ্ঞানসহ প্রায় সব বিভাগে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শুধু শিক্ষকসংকট নয়, একাডেমিক ভবন, মিলনায়তন, পরিবহন, ল্যাব–সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। গত জুনে তিন দিন ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। ওই সময় কলেজ প্রশাসনকে ২৫ দফা এবং শিক্ষা উপদেষ্টা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে ১২ দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
তবে কলেজ প্রশাসন বলছে, দীর্ঘদিন ধরে ‘অবহেলিত’ থাকায় আজকের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য চলতি অর্থবছরে কলেজের উন্নয়নে আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। তবে কলেজের আধুনিকায়নের জন্য বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন।
অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড ব্যারন কারমাইকেল ১৯১৬ সালে এই কলেজের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তাঁর নামেই কলেজের নামকরণ করা হয় কারমাইকেল কলেজ। ১০৯ বছরের পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজকে উত্তরাঞ্চলের বাতিঘরতুল্য বিদ্যাপীঠ বলা হয়ে থাকে।
শিক্ষকসংকট, অপর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ
কারমাইকেল কলেজে মোট বিভাগ ১৮টি। এসব বিভাগে স্নাতক, স্নাতকোত্তরে (পাস কোর্সসহ) শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করেন। এ ছাড়া উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি (পাস কোর্স) মিলে কলেজে মোট শিক্ষার্থী ২৫ হাজারের বেশি। কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ মোট শিক্ষকের পদ ১৮৩। তবে এখন কর্মরত আছেন ১৬৫ জন। সে হিসাবে ১৫১ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১ জন।
কারমাইকেল কলেজের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী রাশিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিন-চার মাস আগেও তাঁদের বিভাগে মাত্র একজন শিক্ষক ছিলেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৬০ শতাংশ ক্লাস বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু শিক্ষকসংকটের কারণে ক্লাস নিয়মমাফিক হয় না। অনেক শিক্ষার্থী প্রাইভেটনির্ভর হয়ে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শিক্ষকসংকটসহ অন্যান্য সমস্যা নিরসনে গত ৮ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিব ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষার্থীদের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল মতবিনিময় করে।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী ছাত্র রিফাত হাসান বলেন, ছোট কিছু দাবি বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে পাঁচ শিক্ষকের যোগদান ছাড়া বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি। কলেজে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা দরকার উল্লেখ করে অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁরা মন্ত্রণালয়কে বলেছেন।
কলেজ সূত্র জানায়, উচ্চমাধ্যমিক ভবনসহ পাঁচটি একাডেমিক ভবন রয়েছে। এর মধ্যে তিনটির অবস্থা করুণ। অধিকাংশ শ্রেণিকক্ষে ফ্যান, বেঞ্চ ও আলোর স্বল্পতা রয়েছে।
সূত্রমতে, শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন অন্তত ১৫০টি; আছে ৯৩টি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সিরাজ আল সুজন তাঁদের বিভাগ সম্পর্কে বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষ তিনটি। আমরা যখন ক্লাস করি, অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এসে দাঁড়িয়ে থাকে।’
আবাসনসংকট প্রকট, ঝুঁকিপূর্ণ হল
কলেজে ছাত্রদের চারটি ও ছাত্রীদের চারটি হল রয়েছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ওসমানী হল ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত। জিএল (গোপাল লাল রায়), কেবি (কাশিম বাজার) ও নবনির্মিত আবু সাঈদ হলে ৩২৮ ছাত্রের আবাসনসুবিধা রয়েছে।
অন্যদিকে জাহানারা ইমাম, বেগম রোকেয়া, তাপসী রাবেয়া ও বীর প্রতীক তারামন বিবি হলে ৮৯৮ ছাত্রী থাকছেন। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রী মিলে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ৫ শতাংশের মতো আবাসনসুবিধা পাচ্ছেন।
‘মানহীন’ মেসে থাকেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী
কারমাইকেল কলেজ ও আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে নগরের খামার মোড়, লালবাগ, পার্কের মোড়, কলেজপাড়া, দর্শনা ও মডার্নে কয়েক শ ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস গড়ে উঠেছে। কয়েকটি মেসে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, থাকা-খাওয়া ও মানসম্মত পরিবেশের অভাব রয়েছে।
লালবাগের কেডিসির গলির একটি মেসে থাকেন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান। তাঁকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। খাওয়া ও অন্যান্য খরচসহ মাসে গুনতে হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। মাহমুদ বলেন, হলে থাকলে এত খরচ হতো না। তাঁদের ব্যাচে ১৩০ জনের মধ্যে ৪-৫ জন হলে থাকেন।
মেসে থাকছেন, এমন ১৫ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা সবাই প্রায় অভিন্ন কথা বলেন, থাকা–খাওয়ায় বেশি খরচ হচ্ছে। যাতায়াতে বেশি সময় লাগে। নিরাপত্তাহীনতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির কথাও বলেন কেউ কেউ।