উড়ন্ত ছাইয়ে বিপর্যস্ত জনপদ, স্বাস্থ্যঝুঁকি 

  • প্রচুর কালো ছাই বাতাসে ভেসে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

  • কালিমিশ্রিত ছাইয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে বলে জানালেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা।

গাজীপুরের শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের তালতলী গ্রামে এভাবে উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ ছাই
ছবি: প্রথম আলো

সড়কের কাছেই কালো কালিমিশ্রিত ছাইয়ের বিশালাকার স্তূপ। এসব ছাইয়ের প্রভাবে দুই শতাধিক বাড়ির প্রায় ছয় থেকে সাত শ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। এই চিত্র গাজীপুরের শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের তালতলী গ্রামের। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আলী পেপার মিল নামের একটি কারখানা অবৈধভাবে উন্মুক্ত অবস্থায় এসব ছাই জমা করেছে।

তালতলী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশের পথে পথে ছড়িয়ে আছে কারখানার কালিমিশ্রিত ছাইয়ের ক্ষতিকর প্রভাবের দৃশ্য। গাছপালার পাতা, ঘরের চাল, বারান্দায় ঝোলানো কাপড়, গৃহপালিত পশুর গায়েও কালির আস্তরণ। বাড়ি আঙিনার খড়ের গাদা কালিতে ছেয়ে আছে। প্রতিটি বাড়ির টিনের চালা কালো রং ধারণ করেছে।

বারবার নিজেদের কষ্টের কথা কারখানার লোকজনকে জানিয়েছি। আমরা গরিব বলে আমাদের কথার কোনো গুরুত্ব নাই। 
নাসির উদ্দিন, স্থানীয় বাসিন্দা

জাহানারা বেগম নামের স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আলী পেপার মিল তাদের কারখানার ভেতরে বিপুল পরিমাণ কাগজ ও ধানের তুষ পোড়ায়। এতে প্রচুর কালো কালি বাতাসে ভেসে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন কাপড় ধুতে হয়।

কারখানার প্রাচীরের পাশে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে গাঢ় কালো রংয়ের ছাইয়ের স্তূপটি ছোটখাটো পাহাড়ের মতো আকার ধারণ করেছে। আশপাশে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে ছাইয়ের কিছু অংশ। এগুলো হাতে নেওয়ার পর ছাই ফেলে দিলেও হাত থেকে কালি সহজে সরানো যাচ্ছিল না।

তালতলী গ্রাম ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। গণমাধ্যমকর্মীর পরিচয় জেনে ভোগান্তির বিষয়ে গ্রামের লোকজন আগ্রহ নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে আসেন। তাঁদের কথায় উঠে আসে কারখানার ছাই ওই এলাকার জনজীবন বিষিয়ে তুলেছে। বাড়িতে
অনবরত কালিমিশ্রিত ছাই উড়তে থাকে। জানালা-দরজা দিয়ে ছাই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। আসবাবে ধুলার স্তর জমে যায়। শিশুসহ বৃদ্ধদের নিশ্বাসে সমস্যা হয়। ১০ বছর ধরে এই ভোগান্তি পোহাচ্ছে স্থানীয় লোকজন। কারখানার লোকজন সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও পরে কোনো ব্যবস্থা নেন না।

কালিমিশ্রিত ছাইয়ের কারণে বারান্দায় ঝোলানো কাপড়ে, গৃহপালিত পশুর গায়েও পড়ে কালির আস্তরণ। ১০ বছর ধরে চলছে এমন ভোগান্তি

স্থানীয় বাসিন্দা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘বারবার নিজেদের কষ্টের কথা কারখানার লোকজনকে জানিয়েছি। আমরা গরিব বলে আমাদের কথার কোনো গুরুত্ব নাই। কেউ আমাদের এই দুর্ভোগ সমাধানে এগিয়ে আসেনি।’

ছাইয়ের কারণে বিভিন্ন ভোগান্তি তুলে ধরে একই গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, কালি বাতাসে ভাসতে থাকে। এতে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগবালাইয়ে ভুগছেন তাঁরা। ধান কাটার পর সেগুলো মাড়াই করার সময় শরীর কালিতে কালো হয়ে যায়। শাকসবজি উৎপাদন করার সুযোগ নেই। কারণ, এসব কালিমিশ্রিত শাকসবজি কেউ কিনবে না।

কালিমিশ্রিত এসব ছাইয়ের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে বলে জানালেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা। শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শিশুবিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আইয়ুব আলী বলেন, দীর্ঘদিন উড়ন্ত ছাইয়ের মধ্যে শিশুরা বেড়ে উঠলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে। অ্যালার্জি বেড়ে যাবে। ফুসফুস চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। একসময় অ্যাজমাসহ ফুসফুসের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল বাতেন সরকার বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি কারখানা কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে, তারা কথা শোনে না, যা খুশি করে। এদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে। সেখানে লোকজনের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো ট্যাক্সও পরিশোধ করে না। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে মানুষগুলো স্বস্তিতে বাঁচতে পারবে।’

আলী পেপার মিলের হিসাব বিভাগের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলামের কাছে টেলিফোনে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গ্রামের কেউ তাঁদের কাছে কোনো ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসেননি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুরের উপপরিচালক নয়ন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাতাসে উড়ন্ত ছাই থাকলে সেটি পরিবেশসম্মত নয়। আমরা বিষয়টি খোঁজ নেব। সেখানে পরিবেশ আইনের ব্যত্যয় ঘটে থাকলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’