রাস্তায় ঘুরে, না ঘুমিয়ে রাত কাটালেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা

রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশে আসা নেতা–কর্মীরা
ছবি: প্রথম আলো

‘সারা রাত রাস্তায় ঘোরাঘুরি করিচি। সমাবেশ মাঠের কাছে গেছুনু। নদীর ধারে গেছুনু। তাঁবুতে তাঁবুতে মানুষ দেকিচি। সারা রাত এনাও ঘুমাইনি’,—রাজশাহীতে বিএনপির গণসমাবেশে এসে গতকাল শুক্রবার রাত এভাবেই কাটিয়েছে মহাদেবপুরের কলেজছাত্র ফারুক হোসেন (১৭)। গতকাল রাত ১০টায় সে ট্রেনে করে রাজশাহী শহরে এসেছে। রাতে ঘুমানোর জায়গাও পায়নি।

রাজশাহীতে গণসমাবেশের জন্য নগরের হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠের (মাদ্রাসা মাঠ) অনুমতি পেয়েছে বিএনপি, কিন্তু তারা শুধু আজ শনিবার বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ওই মাঠ ব্যবহার করতে পারবে। অন্য বিভাগীয় সমাবেশের মতো তারা মাদ্রাসা মাঠে নেতা-কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারেনি। সমাবেশের দুই দিন আগে থেকে পরিবহন ধর্মঘট ডাকার কারণে নগরের পাঠানপাড়া এলাকায় শাহ মখদুম কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে তাঁবু পেতে রাজশাহীর বাইরের জেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগের দুই রাতে মশা ও শীতের কষ্ট থাকলেও নেতা–কর্মীরা তাঁবুতেই মোটামুটি ঘুমিয়েছেন। কিন্তু গত রাতের দৃশ্য ছিল আলাদা। গতকাল বিকেলে প্রচুর জনসমাগম ঘটে। মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ভ্যান, মাইক্রোবাস—যে যেভাবে পেরেছেন, এসে রাজশাহীতে পৌঁছেছেন। এর পর থেকে ঈদগাহ মাঠে আর দাঁড়ানোর মতো জায়গা ছিল না। বেশির ভাগ মানুষ সামনের রাস্তায় অবস্থান নেন।

ঈদগাহ মাঠের পাশের চা–দোকানি আখের আলী (৭২) আজ সকাল সোয়া আটটার দিকে এসে দোকান খুলেছেন। ঠিকমতো চোখ মেলতে পারছেন না। বললেন, ভোর চারটায় ঘুমাতে গেছেন। তবু জোর করে দোকান বন্ধ করেছেন। মানুষ বন্ধ করতে দেন না। সারা রাত রাস্তায় মানুষের ভিড় ছিল। তাঁরা ঘুমাননি।

সকাল সাতটায় ঈদগাহ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, যাঁরা তাঁবুতে দুই দিন ধরে রাত কাটিয়েছেন। তাঁরা ইতিমধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছেন। বেলা দুইটায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও তাঁদের প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা তখনই সমাবেশে যাবেন। তখনো সকালের খিচুড়ি সব তাঁবুতে এসে পৌঁছায়নি। তাই তাঁরা তাঁবুর বাইরে–ভেতরে দাঁড়িয়ে চিড়া-গুড় খাচ্ছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের নেতা-কর্মীরা তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে পলিথিনের ব্যাগে করে চিড়া-গুড় খাচ্ছিলেন। ভোলাহাটের জাম্বাড়িয়া ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক (৩২) বলেন, তাঁদের সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম সবার জন্য চিড়া, গুড় সরবরাহ করেছেন। তাঁরা গত বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার ট্রেনে রাজশাহীতে এসেছেন। একই সঙ্গে এসেছেন তরিকুল ইসলাম (৩৮) ও আবুল কালাম (৫০)। তাঁরাও বলেন, তাঁবুতে বসেই কাটিয়েছেন।

মহাদেবপুরের সোহরাব হোসেন (৪০) গতকাল ভ্যানে করে রাজশাহীতে এসেছেন। তিনি বলেন, সাতবার ভ্যান পরিবর্তন করে রাতে রাজশাহী শহরে ঢুকেছেন। তাঁবুতে ১১০ জন শুয়েছিলেন। তিনি কিছুটা ঘুমিয়েছেন। রাত একটার দিকে জেগে দেখেন, অনেকেই বসে আছেন। বাইরে অনেক মানুষ ঘোরাঘুরি করছেন।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ইয়াহিয়া (৩০) বলেন, ‘৫ জনের জায়গায় ১০ জন শুয়েছিলাম। এভাবে কি ঘুম হয়? রাত কাটানো হয়েছে আর কি।’ হাজি আবুল হোসেন (৭৪) বলেন, ‘নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে বসে ছিলাম। বাতাস বেশি ছিল। ঠান্ডা আর মশার কামড়ে কষ্ট হয়েছে।’ নওগাঁর আলী আকাব্বর বলেন, ‘কয়টায় মিটিং হবে, এই চিন্তায় আছি, ঘুম কি হয়?’

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার চৌহালী এলাকার মুন্নাফ আলী (৩০) বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে ট্রেনে করে তাঁরা ৪২ জন একসঙ্গে এসেছেন। রাতে তাঁবুতে গায়ে কম্বল জড়িয়ে বসে ছিলেন। সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ আলীও (৫৯) বৃহস্পতিবার এসেছেন। তাঁর ভাষায়, রাতে গাদাগাদি করে শুয়েছিলেন, ঘুম হয়নি। তবে উল্লাপাড়ার রফিকুল ইসলাম (৪০) বলেন, তাঁদের তাঁবুতে তিনি ঘুমানোর জায়গা ভালো পেয়েছিলেন। তাঁর ঘুম হয়েছে।

সমাবেশে মানুষ আসা অব্যাহত আছে। ভোর ৫টার দিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে ১০০ জনের একটি দল মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছে। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন পাঁচবিবি পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউল ফেরদৌস। তিনি বলেন, তাঁরা রাত ১২টায় রওনা দিয়েছেন, ভোর ৫টায় এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা আর তাঁবুতে বিশ্রাম নিতে যাননি। এসে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন। সকাল আটটার দিকে নাটোরের সিংড়া থেকে একটি বড় মিছিল এসে ঈদগাহের সামনের রাস্তায় স্লোগান দিতে থাকল, থামছেই না। এই সকালেই একের পর এক স্লোগান, মিছিল, ব্যানার নিয়ে দাঁড়ানো, নিজস্ব এলাকার টুপি পরে নেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে।