ধর্মীয় আধিপত্য বা বিশেষ কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে গণ-অভ্যুত্থান হয়নি: জোনায়েদ সাকি
কোনো ধর্মীয় আধিপত্য বা বিশেষ কোনো মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। আজ শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় চট্টগ্রাম নগরে মাথাল মিছিল-পূর্ব সমাবেশে তিনি এ মন্তব্য করেন। জোনায়েদ সাকি বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জুলাই–আগস্টে গণ–অভ্যুত্থান হয়েছিল। হাজারো তরুণ রক্ত দিয়ে অভ্যুত্থান করেছেন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য।
সারা দেশে গণসংহতি আন্দোলনের মাথাল মিছিলের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ ও মহানগরের যৌথ উদ্যোগে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জোনায়েদ সাকি সংবিধান, সংস্কার, নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণসংহতি আন্দোলনের যে নেতারা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদেরও নেতা-কর্মীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন।
গণসংহতি আন্দোলনের নেতা জোনায়েদ সাকি বলেন, শেখ হাসিনা নানা কূটকৌশল, ষড়যন্ত্র, হামলা, মামলা, অত্যাচার ও খুন করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেছিলেন। জুলাই-আগস্টে ছাত্ররা রাজপথে নেমে এসেছিলেন। শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কারণে বাংলার মানুষ একত্রিত হন। ছাত্ররা এই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখে সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন ও দেশের সব নাগরিক এই সময়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ফ্যাসিবাদমুক্ত রাষ্ট্র গড়তেই হয়েছিল অভ্যুত্থান।
বন্দরের প্রসঙ্গে জোনায়েদ সাকি বলেন, সরকার টিকে আছে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সমর্থনের ভিত্তিতে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা অংশীজন আছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা সরকারের উচিত ছিল। অথচ সরকার এ বিষয়ে আলোচনা না করে বন্দর নিয়ে চুক্তি করেছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমরা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা আমাদের রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণ করেছিলাম। আসুন, আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন গণতান্ত্রিক যাত্রা যাতে সফল হয়, তার জন্য আমরা সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করি। রাজনৈতিক অধিকার আমাদের দরকার। কেননা, রাজনৈতিক অধিকার ছাড়া আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা, আমাদের দাবি তোলার স্বাধীনতা, আমাদের প্রত্যেক মানুষের জীবনের বেঁচে থাকার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে না।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গণসংহতি আন্দোলন শুরু থেকেই এই দেশে শ্রমিক, কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষসহ প্রান্তিক ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তার মূল অঙ্গীকার ছিল নাগরিকদের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত ৫৪ বছরে আমরা সেই সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখিনি।’
সংবিধানের প্রসঙ্গ টেনে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের মূল ভিত্তি নিহিত রয়েছে সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামোতে। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের সরকারপ্রধানের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতা দিয়েছে। এই ক্ষমতাবলে তারা সব প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের পকেটে ঢুকিয়ে জনগণের ওপর অত্যাচার করেছে। সে কারণে আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, কেবল শাসক বা সরকার বদলালে হবে না, শাসনব্যবস্থা এবং সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো বদলাতে হবে, নয়তো দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।’
রাষ্ট্র সংস্কারের নানা ধাপ নিয়ে আলোচনা করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘শাসনব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা হাজির করেছি। এর মধ্যে রয়েছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা। এ অনুচ্ছেদ জনপ্রতিনিধিদের হাত তোলা এমপিতে পরিণত করেছে।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি যেন প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি আমরা জানিয়েছি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করার দাবিও আমরা জানিয়েছি। বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন জায়গায় নিয়ে আসা, যাতে একে প্রভাবিত করা না যায়, সংসদকে দ্বিকক্ষ হিসেবে তৈরি করে ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ নানা দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছি।’
কেবল রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই মানুষের পেটে ভাত জোটে না বলে মনে করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি যদি লুটের অর্থনীতি হয়, তাহলে সম্পদ শোষণ হবে, বিরাট বৈষম্য তৈরি হবে, টাকা পাচার হবে; কিন্তু মানুষের মুক্তি আসবে না। সেই কারণে আমরা মনে করি, রাজনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি খেটে খাওয়া মানুষের ন্যায্য হিস্যা এবং প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মিছিল-পূর্ব সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলন মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রাম-২ আসনের প্রার্থী মিজানুর রহিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৪ আসনের জাহিদুল আলম, চট্টগ্রাম-৫ আসনের কলি আক্তার, চট্টগ্রাম-৬ আসনের নাসির উদ্দীন তালুকদার, চট্টগ্রাম-৯ আসনের হাসান মারুফ রুমী, চট্টগ্রাম-১০ আসনের অপূর্ব নাথ, চট্টগ্রাম-১১ আসনের সৈয়দ সালাউদ্দিন শহীদ শিমুল প্রমুখ। সমাবেশ শেষে মিছিলটি নগরের কাজীর দেউড়ি থেকে শুরু হয়ে আন্দরকিল্লা মোড়ে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।