তাঁদের জীবন যেন পল্লিকবির ‘আসমানীর’ মতো

শরীয়তপুর সদর উপজেলার চর ডোমসার গ্রামে বেদেপল্লিতে প্লাস্টিকের ছাপরায় বসবাস করেন গোলাপী বেগম। ছবি সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।’

পল্লিকবি জসীম উদ্‌দীন গ্রামবাংলার অসহায় মানুষের চিত্র তুলে ধরেছিলেন ‘আসমানী’ কবিতায়। কীর্তিনাশা নদীর তীরে আসমানীর মতো কষ্টের জীবন যাপন করছেন তুফানি, রোকেয়া, গাছিরুন ও গোলাপীরা। ভেন্না পাতার প্রচলন না থাকলেও প্লাস্টিকের ছানি দেওয়া ছাপরার মধ্যেই জীবন কাটাচ্ছে শরীয়তপুর সদর উপজেলার চর ডোমসার গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবার।

বেদেপল্লির বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত পরিবারগুলো অর্থকষ্টে বসতঘর বানাতে পারছে না। তাদের আদি পেশায় আয় কমে যাওয়ায় চলতে কষ্ট হচ্ছে। সদর উপজেলা ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হলেও তাদের ভাগ্যে জোটেনি খাসজমি বা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর।

বেদেপল্লির বাসিন্দারা বলেন, শরীয়তপুর সদর উপজেলার চর ডোমসার গ্রামটি জেলা শহর লাগোয়া কীর্তিনাশা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯৯৫ সাল থেকে এই গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। এখানে বর্তমানে ১৫০টি পরিবারের বসবাস। তাদের আদি নিবাস মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার খৈরা গ্রামে। পদ্মার ভাঙনে বসতবাড়ি বিলীন হলে নিঃস্ব পরিবারগুলো এখানে আসে। ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদে জন্মনিবন্ধন ও ভোটার তালিকায় এসব পরিবারের সদস্যরা নাম লেখান।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন আছে। এতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩০২টি পরিবারকে জমি ও পাকা ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ২০ মার্চ সদর উপজেলাকে ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু চর ডোমসারে বসবাস করা বেদেপল্লির বাসিন্দারা এগুলো পাননি।

সম্প্রতি চর ডোমসার গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অন্তত ৩০টি পরিবারের কোনো বসতঘর ও জমি নেই। এসব পরিবারের সদস্যরা অন্যের জমিতে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে ছাপরা নির্মাণ করে বসবাস করছেন। ঝড়-বৃষ্টি হলে ছাপরা ভেঙে যায়। পরে সেটাই মেরামত করে বসবাস করেন। বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় স্থানীয়ভাবে তাঁরা অন্য কোনো কাজ পান না। ফলে তেমন আয় নেই তাঁদের।

বেদেপল্লির বাসিন্দা রোকেয়া বেগমের (৫৬) স্বামী শাহজাহান সরদার মারা গেছেন সাত বছর আগে। ছেলে রিপন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারেন না। প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া একটি ছাপরাতে তিনি ছেলেকে নিয়ে থাকেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে শরীয়তপুর চইল্লা আইছি। বেদেপল্লির মানুষেরা থাকনের জায়গা দিছে। কোনো ঘর নাই। প্লাস্টিকের ছাউনিতে থাকি। বৃষ্টি নামলে পানি পড়ে, ঝর হইলে ঘর উড়াইয়া লইয়্যা যায়, শীতে ঠান্ডা বাতাস লাগে। এভাবেই বছরের পর বছর কষ্ট করে বেঁচে আছি। মাসে ৫০০ টাকা বিধবা ভাতা পাই। তাতে কি সংসার চলে?’

শরীয়তপুর সদর উপজেলার চর ডোমসার গ্রামে প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ছাপরায় থাকে অন্তত ৩০টি পরিবার
ছবি: প্রথম আলো

৭০ বছর বয়সী গোলাপী বেগমের ছেলে পিন্টুর স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সময় দুই মেয়ে রেখে গেছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পিন্টু বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। দুই নাতনিকে নিজের কাছে রেখেছেন গোলাপী। ৬ বছর আগে তাঁর স্বামীও মারা যান। নাতনিদের একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। নিজে আয় করতে পারেন না। তাঁর অন্য ছেলেরাও ভরণপোষণ দেন না। তাই মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য নিয়ে চলতে হয় গোলাপীকে।

গোলাপী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার সময় ৩ শতাংশ জমি রেখে গিয়েছিলেন। এর ওপর প্লাস্টিকের ছাপরায় দুই নাতনিকে নিয়ে থাকেন। ঝড়-বৃষ্টি, শীতে ছাপরায় থাকতে অনেক কষ্ট হয়। বয়স্ক ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতা পান, তবে তাতে চলে না। নাতনিদের রোগশোক লেগে থাকে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না।

সাত্তার হোসেনের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তুফানি বেগমকে (৩০) বিয়ে করেন। তাঁদের এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করাতে পারছেন না। অন্যের জমিতে অস্থায়ী প্লাস্টিকের ছাপরা নির্মাণ করে বাস করছেন। সেই ঘর ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁর।

তুফানি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাগো একটা আশ্রয় ও মাথাগোজার ঠাঁই দরকার। গায়ে রত (শরীরে শক্তি) আছে পরিশ্রম কইরা পেটের খাবার জোগাড় করতে পারুম। কিন্তু জমি কিনে ঘর বানাইতে পারুম না। দেশের কত মানুষ ঘর পাইল, আমরা কেন একটা ঘর পাইলাম না? আমরাও তো তাগোরে ভোট দিই।’

ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চর ডোমসার এলাকার বেদেপল্লির বাসিন্দারা অনেক কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁদের কয়েকজনকে ভিজিডি ও টিসিবি কর্মসূচির আওতায় সহায়তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েকজনকে বিভিন্ন ধরনের ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

সদর উপজেলার ইউএনও জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেদেপল্লির বাসিন্দাদের অসহায়ত্বের খবর আমাদের কেউ জানাননি। তাঁদের ঘর প্রয়োজন, এমন জানতে পারলে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হতো। কয়েক দিন আগে তাঁদের কয়েকজন আবেদন করেছেন। এখন তাঁদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’