একসময় সবই ছিল, এখন টুথপিকের আয়েই চলে জীবন
একসময় চাষের জমি ছিল। গোয়ালভরা গরু ছিল। সংসারে ছিল সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য। এখন জীবন চলে বাঁশের তৈরি দাঁতখিলাল (টুথপিক) বিক্রি করে। জীবনের শেষ বেলায় সংসারের হাল ধরার কেউ না থাকায় স্ত্রী, প্রতিবন্ধী মেয়ের মুখে দুমুঠো ভাতের একমাত্র ভরসা এখন বাঁশকাঠির খিলাল। এ গল্প রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার প্রামাণিকপাড়া গ্রামের আবদুল লতিফের (৭৫)।
১৯৯৪ সালের কথা। লতিফের বাড়ির অদূরেই ইকরচালী হাটে গিয়ে নিখোঁজ হন একমাত্র ছেলে এরশাদ উদ্দিন। সেই ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে গোয়ালের গরু, দুই একর আবাদি জমি, এমনকি থাকার ঘর পর্যন্ত বিক্রি করে দেন তিনি। একপর্যায়ে নিঃস্ব হয়ে পড়লেও ছেলেকে ফিরে পেতে দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করে খুঁজে বেরিয়েছেন। কিন্তু ছেলে এরশাদকে ফিরে পাননি লতিফ।
লতিফ বলেন, ‘৩০ বছর আগেও আমার সব ছিল। মানুষ আমার বাসায় কাজ করেছে। ছেলেকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। যখন যেখানে খবর পেয়েছি, ছেলের সন্ধানে ছুটে গেছি। কিন্তু ছেলেকে পাইনি। সংসারে হাল ধরার মতো কেউ নেই। বয়স বেড়ে যাওয়া কাজ করতে পারি না। তাই বাঁশ দিয়ে খিলাল তৈরি করে দোকানে দোকানে বিক্রি করি। এটাই এখন আমার বেঁচে থাকার সম্বল।’
লতিফ জানান, সংসারে ছয় সন্তান তাঁর। পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে। সবার ছোট ছেলে এরশাদ ১৯৯৪ সালে বাজারে গিয়ে হারিয়ে যায়। চার মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী মেয়ে হালিমা ও স্ত্রী ছিদ্দিকাকে নিয়ে তিন সদস্যের সংসার তাঁর। ৭ বছর ধরে বাঁশ কিনে বাড়িতে খিলাল তৈরি করে রংপুর শহর, তারাগঞ্জসহ বিভিন্ন বাজারের হোটেলে বিক্রি করেন তিনি। এতে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলছে তাঁর সংসার। একটি বাঁশ দেড় শ টাকায় কিনলে তা দিয়ে খলিল তৈরি করে ৪০০ টাকা বিক্রি করেন।
লতিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা ঘরের উঠানে বসে পরম মমতায় বাঁশ দিয়ে দাঁতখিলাল তৈরিতে ব্যস্ত তিনি। স্ত্রী ছিদ্দিকা বেগম তাঁকে সহযোগিতা করছেন। উঠানে বস্তার ওপর রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে বাঁশের দাঁতখিলাল। সেগুলো পাহারা দিচ্ছেন প্রতিবন্ধী মেয়ে হালিমা।
স্ত্রী ছিদ্দিকা বেগম বলেন, ‘আল্লাহ কখন কার কপালে কী রেখেছেন, তা তিনিই ভালো জানেন। একসময় গোয়ালভরা গরু, ডুলিভরা ধান ছিল। ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে সব শেষ। আজ আমাদের দেখার কেউ নেই। বাঁচার জন্য খাওয়া দরকার। সে জন্য স্বামীকে বাঁশের খিলাল তৈরি করে দিচ্ছি। খিলাল বিক্রি করে ভাত-কাপড় জুটছে। আমাদের বাঁশের খিলালের চাহিদা ভালো।’
প্রতিবেশী স্যাকলাইন প্রামাণিক বলেন, লতিফ চাচার জীবনে অনেক ট্র্যাজেডি রয়েছে। তাঁর একমাত্র ছেলে হারিয়ে গেছে। এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। বসতভিটা ছাড়া কোনো সহায়-সম্বল নেই। তবু তিনি অন্যের কাছে হাত পাতেন না। লতিফ চাচা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। জীবনের শেষ সময়েও তিনি বাঁশের খিলাল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাঁর মতো সৎ লোক খুব দুর্লভ।
স্থানীয় ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন বলেন, ‘লতিফ ভাই কখনো সাহায্যের জন্য পরিষদে আসতেন না। আমরা উপযাচক হয়ে তাঁকে অনেক সময় সহায়তা করেছি।’