চট্টগ্রাম নগর
ধুলার যন্ত্রণায় পথচলা দায়
নির্মাণকাজ, যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, বর্জ্য পোড়ানো, ইটভাটা এর প্রধান কারণ। শীত আসতে আসতে এর মাত্রা দ্রুত বেড়ে চলছে।
বেলা ১১টা। চট্টগ্রাম নগরের দামপাড়ার বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (বাওয়া) উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে যানজট লেগে আছে। একপাশে চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের কাজ। পুরো এলাকায় উড়ছে ধুলাবালু। নাকে–মুখে হাত দিয়ে কিংবা মাস্ক লাগিয়ে পথচারীরা ধুলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করে চলেছেন। বাওয়া স্কুলকে কেন্দ্র করে দুই পাশে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকায় এই ধুলার যন্ত্রণা। গত সোমবার এ চিত্র দেখা যায়।
একইভাবে নগরের নিমতলা এবং ইপিজেড এলাকায়ও চলছে র্যাম্প তৈরির কাজ। আর যেখানেই এ ধরনের নির্মাণকাজ সেখানেই ধুলাবালুর ‘ঝড়’।
এসব এলাকা ছাড়া নগরের নাসিরাবাদ, ষোলশহর, আগ্রাবাদ, জাকির হোসেন সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে এখন বায়ুদূষণ বেড়েছে। নির্মাণকাজ, যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, বর্জ্য পোড়ানো, ইটভাটা এর প্রধান কারণ। শীত আসতে আসতে এর মাত্রা দ্রুত বেড়ে চলছে।
বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের নানা সংক্রমণ হয়। এ ছাড়া শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ বা অ্যালার্জি হতে পারে। বায়ুজনিত দূষণ থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করা যায়। এতে মোটাদাগে কিছু লাভ হবে। কিন্তু সেটা মূল সমাধান নয়। দূষণ থেকে বাঁচতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।অধ্যাপক জসিম উদ্দিন, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
এর ফলে শীত আসতেই অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের মতে, বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ার এ সময়ে রোগীও বেড়ে যায়।
বায়ুমান নিয়ে কাজ করে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। সে অনুযায়ী গত কয়েক দিনে ঢাকার বায়ুমান ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। তবে সে তুলনায় চট্টগ্রামের বায়ুমান অতটা অস্বাস্থ্যকর নয়। তারপরও তা সহনীয় মানমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। আইকিউএয়ারের ২০২৩ সালের বছরভিত্তিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণ বেশি বাংলাদেশে।
বাতাসের মানমাত্রা
বায়ুদূষণের বড় কারণ অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫)। গত মাসের ২১ নভেম্বর চট্টগ্রামের বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ প্রতি ঘনমিটারে ২৩০ মাইক্রোগ্রাম, যা সহনীয় মাত্রার চার গুণ। সহনীয় মাত্রা ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। নভেম্বর মাসে বাতাসে গড়ে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল ১১৯ মাইক্রোগ্রাম, যা ২০১৩ সালে ছিল ৮১ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৬ সালে ছিল ৭৬ মাইক্রোগ্রাম।
বায়ুদূষণে ভূমিকার রাখে একটু বড় বস্তুকণা পিএম-১০। ২১ নভেম্বর বাতাসে পিএম-১০–এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ২৮৩ মাইক্রোগ্রাম। ওই মাসে গড়ে পিএম-১০ ছিল ১৫৪ মাইক্রোগ্রাম। সহনীয় মাত্রা ১৫০ মাইক্রোগ্রাম।
চট্টগ্রামের বাতাসে অক্টোবর মাসে গড়ে পিএম ২.৫ ছিল ২৪৩ মাইক্রোগ্রাম। একই মাসে পিএম-১০ ছিল গড়ে ২৯১ মাইক্রোগ্রাম।
চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ, জাকির হোসেন রোডের টিভি স্টেশন এবং আগ্রাবাদে বায়ু পরিমাপের তিনটি সেন্টার রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার বাতাস পরিমাপ করা হয়। তবে দুই মাস ধরে আগ্রাবাদ কেন্দ্রটির বাতাসের বস্তুকণা পরিমাপ করতে পারছে না। এই কেন্দ্রের তার চুরি হয়ে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
আবার টিভি কেন্দ্রের পাশের বায়ু পরিমাপ কেন্দ্রটি ভেতরে হওয়ায় দূষণের সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। ওই এলাকার চেয়ে জিইসি, বন্দরটিলা, ইপিজেড এলাকায় দূষণের মাত্রা আরও বেশি।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের পরিচালক নাসিম ফারহানা শিরিন বলেন, ‘নিয়মিত কারখানাগুলোর ধোঁয়া পরিমাপ করা হয়। এ ছাড়া তিনটি কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিমাপ চলে। যেসব জায়গায় নির্মাণকাজ চলে সেখান থেকে অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ ছাড়া নিয়মিত যানবাহন এবং কলকারখানার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়।’
চারপাশে ধুলার আস্তরণ
সরেজমিনে দেখা গেছে, জিইসি এলাকায় উড়ালসড়কের পিলারের গায়ে ধুলার আস্তরণ পড়েছে। সড়ক বিভাজকের মাঝখানে থাকা গাছপালাও ধুলায় সাদা হয়ে রয়েছে। নগরের বাওয়া স্কুলের সামনে কিংবা ওয়াসা মোড়ে চলমান উন্নয়নকাজের সময় ধুলার ওড়াউড়ি বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কোনো সংস্থা থেকে নেওয়া হয় না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
মো. সেলিম নামের এক পথচারী বলেন, প্রতিদিন এখানে ধুলা ওড়ে। পাশে বাওয়া স্কুল এবং পুলিশ লাইনস স্কুলের অবস্থান। শিশু–কিশোররা এই ধুলার ভুক্তভোগী। সবার হয়তো একসঙ্গে অসুখ হবে না। কিন্তু এটার দীর্ঘমেয়াদি ফল তো রয়েছে।
নগরে দূষণজনিত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। এই সময়টাতে অ্যাজমাসহ নানা রোগ বেড়ে যায়। হাসপাতালগুলোতেও এসব রোগী ভিড় করেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের নানা সংক্রমণ হয়। এ ছাড়া শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ বা অ্যালার্জি হতে পারে। বায়ুজনিত দূষণ থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করা যায়। এতে মোটাদাগে কিছু লাভ হবে। কিন্তু সেটা মূল সমাধান নয়। দূষণ থেকে বাঁচতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।