‘মাকে খুঁজতে খুঁজতে শিশুরা কাঁদে, সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আমিও কাঁদি’

নদী থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া দুই শিশুসন্তান বুঝতে পারছে না, তাদের মা আর নেই। বাবা আজবাহার মাতবর ও দাদা শাজাহান মাতবরের কোলে থেকে দিন কাটছে তাদের
ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার আট দিন পরও সালমা বেগম (৩০) নামে এক গৃহবধূর সন্ধান পাওয়া যায়নি। দুই সন্তানকে জীবিত উদ্ধার ও আরেক সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করা গেলেও তাদের মায়ের পরিণতি জানেন না স্বজনেরা।

নড়িয়া উপজেলার জপসা ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামটি কীর্তিনাশা নদীর তীরে। নড়িয়া থানার পুলিশ ও স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই গ্রামের শাজাহান মাতবরের ছেলে আজবাহার মাতবর প্রায় ১০ বছর আগে কীর্তিনাশা নদীর পূর্ব পাড়ের পাচক গ্রামের লোকমান ছৈয়ালের মেয়ে সালমা বেগমকে বিয়ে করেন। আজবাহার ও সালমা দম্পতির সাহাবীর (৭), আনিকা (৩) ও সলেমান নামে দেড় বছরের এক সন্তান আছে। সম্প্রতি সালমার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নানা বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। বিষয়টিতে সালমা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ৫ নভেম্বর সকালে সালমা তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে স্বামীর বাড়ি থেকে বের হন। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি সন্তানদের নিয়ে কীর্তিনাশা নদীতে ঝাঁপ দেন।

আরও পড়ুন

দুই সন্তান আনিকা ও সলেমান ডায়াপার পরা থাকায় তারা পানিতে ভেসে ছিল। শিশুদের ভাসতে দেখে স্থানীয় লোকজন তাদের জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন। খবর পেয়ে সালমার স্বজন ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কীর্তিনাশা নদীতে তাঁদের উদ্ধারে সন্ধান শুরু করেন। পরদিন সোমবার ওই নদী থেকে সালমার বড় ছেলে সাহাবীরের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

গত আট দিনে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও স্বজনেরা সালমার কোনো সন্ধান পাননি। নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ নড়িয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। এরপর সালমার ছেলে সাহাবীরের লাশ উদ্ধারের পর একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
নড়িয়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা হাবীবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওই নারী নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলের কাছাকাছি তাঁর এক ছেলের লাশ উদ্ধার হয়। এরপর কীর্তিনাশার ৬ কিলোমিটার ভাটির দিকে আরও এক দিন অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু ওই নারীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাই উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, পুলিশ কীর্তিনাশা নদীর বিভিন্ন স্থানে এখনো ওই নারীর সন্ধান করছে।

সালমার মেয়ে আনিকা ও ছেলে সলেমান বুঝতেই পারছে না, তাদের মা নেই। মাঝেমধ্যে তারা মায়ের জন্য কান্না করছে। শিশুদের সামলে রাখছেন বাবা আজবাহার ও দাদা শাজাহান।

আরও পড়ুন

আজবাহার মাতবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সালমার মনের ভেতর কিসের এত রাগ ও অভিমান ছিল, তা টের পাইনি। কেন সে সন্তানদের নিয়ে এ রকম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা–ও জানতে পারলাম না। নদীতে এখনো ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। জানি না তাঁকে কখনো খুঁজে পাব কি না। আমাদের এক সন্তানকে বাড়িতেই কবর দিয়েছি। দুই সন্তান কিছুই বুঝছে না। তারা মাঝেমধ্যে মাকে খুঁজতে খুঁজতে কান্না করে। আমি তাদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কান্না করি।’

সালমার বাবা লোকমান ছৈয়াল বলেন, ‘সালমার শাশুড়ি ও দুই ননদ তাঁকে জ্বালাতন করতেন। এ নিয়ে তিনি মানসিক অশান্তিতে ছিল। আমাদের জানালে আমরা মানিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিতাম। কিন্তু ওর মনের ভেতর যে এত কষ্ট ও অভিমান জমে ছিল, তা জানতাম না।’