উদ্বোধনের ১৭ মাসেও সাড়া না থাকার পেছনে ৭ কারণ

কেন্দ্র পরিচালনায় নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনেকটা অলস সময় পার করে সরকারি সুবিধা গ্রহণ করছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার মানচিত্র

ব্যবসায়ীদের এক শেডে ফেরাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নির্মিত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর। কেন্দ্রে এসে ব্যবসা পরিচালনা করতে কর্তৃপক্ষ বারবার লিখিত ও মৌখিক আমন্ত্রণ জানিয়ে চলেছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ১৭ মাসে একটিবারের জন্য আমন্ত্রণ রক্ষা করেননি, বরং এড়িয়ে চলছেন। 

এ অবস্থায় প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অবতরণ কেন্দ্রটি অবহৃত পড়ে আছে। উল্টো কেন্দ্র পরিচালনায় নিযুক্ত কর্মকর্তা–কর্মচারীরা অনেকটা অলস সময় পার করে সরকারি সুবিধা গ্রহণ করছেন। তবে শেষ চেষ্টা হিসাবে কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে।       কমিটির প্রধান কাজ বুঝিয়ে শুনিয়ে ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রমুখী করা।

মো. ছিদ্দিকুর রহমান ভৈরব মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গত সোমবার সকাল ১০টায় অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে পুরো কার্যালয় তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষার পরও কারো খোঁজ মিলেনি। পরে মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, তাঁরা তো (ব্যবসায়ী) আমন্ত্রণই গ্রহণ করছেন না। কথা বলতে আসছে না। বলাবলি সক্রিয় থাকলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।

এদিকে অবতরণ কেন্দ্রবিমুখতার কারণ জানতে কয়েক দিনে ২৫ জন ব্যবসায়ী ও নেতাদের সঙ্গে কথা হয়। জানা গেল কেন্দ্রটিকে ঘিরে কারও মধ্যে এখন আর এতটুকু আকর্ষণ নেই।  

ব্যবসায়ীরা জানালেন, অবতরণ কেন্দ্রে ঘর পেতে হলে সরকারি নিয়ম হলো প্রতি কক্ষের বিপরীতে দুই লাখ টাকা আগাম জমা দিতে হবে। মাসিক ভাড়া দুই হাজার টাকা আর বিক্রীত মাছের দেড় শতাংশ কমিশন সরকারকে দিতে হবে। সরকারি এই নিয়ম কোনো ব্যবসায়ীর পছন্দ হয়নি। 

দ্বিতীয় কারণটি হলো ভৈরব নৈশ মৎস্য আড়তের বয়স ৩০ বছর। বর্তমানে আড়তে প্রায় দুই শ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সমিতির নিবন্ধিত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১৭৬ জন। এর মধ্যে অন্তত ১০০ জন আছেন, যাঁদের ব্যবসার বয়স দুই যুগের বেশি। তাঁদের অনেকে এখন আড়তে নিজের কেনা ঘরে ব্যবসা করছেন। ফলে নিজের ঘরটি মূল্যহীন করে কেন্দ্রটিতে যাওয়ার আগ্রহ নেই একাংশের। 

অবতরণ কেন্দ্রে ঘরের সংখ্যা ৩৫। আর আড়তে প্রায় ২০০। একসঙ্গে সবার স্থান সংকুলান হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় কেউ নতুন স্থানে গিয়ে ব্যবসার বাড়তি ঝুঁকি নিতে রাজি হচ্ছেন না। অবতরণ কেন্দ্রবিমুখতার এটি তৃতীয় কারণ।

চতুর্থ কারণ হিসেবে অবতরণ কেন্দ্রের ভেতর ও বাইরের জায়গাস্বল্পতাকে সামনে আনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ভাষ্য আড়তের জায়গা বিস্তৃত। সহজে মাছ লোড আনলোড করা যায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ২০ হাজার মানুষ। অবতরণ কেন্দ্রের ছোট জায়গায় এতসংখ্যক লোকের পা ফেলার জায়গা থাকার সুযোগ নেই।

পঞ্চম কারণটি হলো ভৈরব আড়তে মাছ আসে কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোন হাওর থেকে। নদীপথে দূর থেকে আসার কারণে প্রায় সময় মাছ অবিক্রীত থেকে যায়। তখন সেই মাছ সংরক্ষণ করতে গিয়ে নানা বিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল অবতরণ কেন্দ্রে অন্য সুবিধা কমিয়ে হলেও হিমাগার যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়। অবতরণ কেন্দ্রে ব্যবসায়ীদের এই দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে কেন্দ্রটি ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ হারায়।

ষষ্ঠ কারণ দিন দিন মৎস্য আড়ত ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এখন আর আগের মতো হাওরের মাছ আসে না। বেশির ভাগ ঘর কোনো কোনো দিন মাছশূন্য থাকে। মন্দা সময়ে নতুন বিনিয়োগ করে নতুন স্থানে যেতে কারো আগ্রহ নেই।  

সপ্তম কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অবতরণ কেন্দ্রটি থেকে আড়তের পায়ে হাঁটা দূরত্ব কয়েক মিনিটের। অথচ নির্মাণের আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো রকম মতবিনিময় করা হয়নি। ফলে শুরু থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। চাহিদাগুলো অজানা থেকে যায়। এতে কেন্দ্রটি ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না।

ভৈরব মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. জায়নাল আবেদীন বলেন, আড়তের অবস্থা ভালো নয়। পুরো ব্যবসায় অর্থনৈতিক ঝুঁকিটা বড়। এ অবস্থায় নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন করে ঝুঁকি বাড়ানো সম্ভব নয়।