‘মেয়েগুলো একটু মাছ দিয়ে ভাত খেতে চায়। অথচ তাদের মুখে ভাত জোটাতেই পারছি না। শেষ কবে মাছ-মাংস খেয়েছি মনে নেই। নিজের চিকিৎসার ওষুধই ঠিকমতো কিনতে পারি না। কেউ হুইলচেয়ারে তুলে দিলে কোনোরকমে কিছু দূর যেতে পারি।’
কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সৈয়দপুর ইউনিয়নের মহানগর এলাকার মোবারক আলী মুহুরিবাড়ির বাসিন্দা পঙ্গুত্ব বরণকারী ইলিয়াস মঞ্জু। ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরের বন্দরের নিউমুরিং লেবার কলোনি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। পরে তাঁর কোমর থেকে নিচের দিকে অবশ হয়ে যায়।
সম্প্রতি ইলিয়াস মঞ্জুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির এক কোনায় উঁচু ভিটেতে টিনশেডের একটি ঘর। হুইলচেয়ার দিয়ে ঘরে ওঠার জন্য রাস্তা করে দিয়েছে একটা এনজিও সংস্থা।
ঘরের বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন ইলিয়াস। সঙ্গে ছিল তাঁর ছোট মেয়ে। কোমর থেকে নিচের নড়াচড়া করতে পারেন না তিনি। প্রস্রাবের জন্য আলাদা একটা নল লাগানো আছে।
ইলিয়াস মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একটি কনজিউমার কোম্পানিতে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। সেদিন খুব ভোরে তিনি কাজে চলে যান। একটি অটোভ্যানে করে মালামাল নিয়ে লেবার কলোনি এলাকায় বিভিন্ন দোকানে যাচ্ছিলেন।
রেললাইন এলাকায় বন্দরগামী একটি ট্রেনের ধাক্কায় তার ভ্যান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এ সময় তিনি ভ্যানের নিচে পড়ে যান। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। পরে নগরের বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও তাঁর কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত অবশ হয়ে যায়।
স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে ইলিয়াস মঞ্জুর সংসার। বড় মেয়ে মুশফিরাত এখন দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে নাজিফা আক্তার শিশুশ্রেণিতে পড়ে। ‘একসময় আমার আয়েই চারজনের সংসারের সব খরচ চলত। এখন আমি নিজেই অচল হয়ে পড়ে রয়েছি,’ আক্ষেপ করে বলেন ইলিয়াস মঞ্জু।
দুর্ঘটনার পর চিকিৎসার খরচ জোগাতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিজমা, স্ত্রীর গয়নাগাটি বিক্রি করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি। তারপরও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তিন মাস অন্তর ২ হাজার ৫০০ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা পান তিনি। ২০২১ সালে স্থানীয় বিঅ্যান্ডএফ কেয়ার নামে এক স্বেচ্ছাসেবী ফাউন্ডেশন তাঁকে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনে দিয়েছিল। রিকশাটি একজন চালকের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ২০০ টাকা ভাড়া দেন ওই চালক। মাসে পাঁচ হাজার টাকার মতো হাতে থাকে।
তাই দিয়েই কষ্ট করে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান মঞ্জুর। কখনো কোনো আত্মীয়স্বজন দেখতে এলে কিছু সহযোগিতা করে যান।
বিঅ্যান্ডএফ কেয়ার নামে স্বেচ্ছাসেবী ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক মো. আশরাফুল আলম ভূঁইয়া বলেন, তাঁদের সংগঠন মানুষের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা করে না; বরং স্বাবলম্বী করে দেওয়ার চেষ্টা করে। ২০২১ সালে ইলিয়াস মঞ্জুর অবস্থা দেখে তাঁরা একটা অটোরিকশা দিয়েছিলেন। তাঁর বিকল্প আরও কিছু ব্যবস্থা দরকার। কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলে হয়তো পরিবারটি কোনোমতে চলতে পারবে।
এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পান ইলিয়াস মঞ্জু। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিল থেকে কিংবা জেলা প্রশাসনের সংরক্ষিত তহবিল থেকে তাঁকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হবে।