চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, গরম কিছুটা কমলেও স্বস্তি মেলেনি

তীব্র গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে শরীরে পান ঢালছেন এক শ্রমিক। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দৌলাতদিয়াড় এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

কাঠফাটা রোদ্দুর। চুয়াডাঙ্গা শহরের বড়বাজার শহীদ হাসান চত্বর অনেকটাই খাঁ খাঁ করছে। সড়কদ্বীপে দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্য ঘেমে একাকার। পুলিশ বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ চলে যায় পুরাতন গলির বাজারের মুখে ছাতা মাথায় এক ফল বিক্রেতা ও তাঁর পাশে গামছা মাথায় এক হকারের দিকে।

এক-পা, দু’পা করে সেখানে গিয়ে পরপর কয়েকটি ছবি তোলার পর দুজনের নাম–ঠিকানা জানতে চাইলে, ছাতা মাথার লোকটি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, নাম-পরিচয় বললে কী গরমের কষ্ট কমবে? এরপর এক নিশ্বাসে বলেন, ‘যদি জানা থাকে থালি বোলেন, কবে তাপ কোমবে, কবে বিষ্টি হবে, শরীলডা পুড়ে কয়লা হয়ে গ্যালো, আর ভাল্লাগে না।’ পাশে গামছা মাথায় বসা হকারটিও মাথা নাড়িয়ে আগেরজনের বক্তব্যে সমর্থন দিলেন।

চুয়াডাঙ্গায় এপ্রিলে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। চুয়াডাঙ্গার পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার প্রতিষ্ঠার পর ৪০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ডও ছিল এটি। স্থানীয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করে বলছিলেন, মে মাসের ২ তারিখ বৃহস্পতিবার থেকে তাপমাত্রা কমে পরিবেশ শীতল হতে থাকবে। তবে তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও তা স্বস্তি দিতে পারেনি চরমাভাবাপন্ন জেলা চুয়াডাঙ্গায় বসবাসকারী মানুষকে।

আবহাওয়া পর্যবেক্ষণগার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আদ্রতা ছিল ২৯ শতাংশ। জেলাজুড়ে এখনও বয়ে চলেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। ঘরে-বাইরে সবখানেই মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। বাড়ির নারী ও শিশু সদস্যরা রয়েছে বেশি অস্বস্তিতে। বিশেষ করে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের অবস্থা খুবই করুন।

আবহাওয়া পর্যবেক্ষণগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপের রেকর্ড থেকে গত দুই দিনে তাপমাত্রা মোট ১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমেছে। এভাবে ১ ডিগ্রি বা তার কিছুটা বেশি হারে তাপমাত্রা কমতে থাকবে। আপাতত চুয়াডাঙ্গাবাসীকে তাতেই সন্তোষ্ট থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘এ জেলায় বর্তমানে তাপমাত্রা বাড়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ৫মে চুয়াডাঙ্গা জেলায় বৃষ্টিপাত হলেও তা সারা জেলায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে ৬ তারিখ থেকে ঝুম বৃষ্টি নামবে এবং তাপমাত্রা স্বাভাবিকের কাছাকাছি চলে আসবে।’
আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সদর ও আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে মাঠে মাঠে কৃষি শ্রমিকদের ধানকাটায় ব্যস্ত দেখা যায়। ভ্যাপসা গরমে ধানকাটা শ্রমিকদের চোখে-মুখে চরম অস্বস্তি দেখা যায়। কিছুদূর পরপর শ্রমিকদের ধানকাটা ছেড়ে গাছের নীচের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দেখা যায়।

আলমডাঙ্গার খাসকররা ইউনিয়নের রায়সা গ্রামের মাঠে গাছের নীচে চারজন শ্রমিক বিশ্রাম করছিলেন। পাশেই বসেছিলেন খেতমালিক জাহাঙ্গীর আলম জানান, চার বিঘা জমিতে তিনি হাইব্রিড-৬ ধানের আবাদ করেছেন। গরমের কারণে শ্রমিকেরা মাঠে কাজ করতে চাইছে না। অনেক অনুরোধ করে চারজন শ্রমিক জোগাড় করতে পেরেছি।  

দুপুরে সদর উপজেলার দৌলাতদিয়াড়ে একটি ময়দা মিলের সামনে পানির পাইপে অনবরত মাথাসহ সারা শরীরে পানি ঢালছিলেন শ্রমিক সরদার রাজা মিয়া। পাশেই কয়েকজন শ্রমিক হাতে-মুখে পানি দিয়ে স্বস্তি খুঁজছিলেন। উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের মনিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা রাজা মিয়া জানান, গরমে কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা সব কাহিল। তিনি বলেন, ‘অসহ্য গরমে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মালিকির নির্দেশেই শ্রমিকদের বিশ্রাম দিতি হচ্চে। তা নাহলি তো গরমে মইরে যাবে।’

চুয়াডাঙ্গা শহরের মল্লিকপাড়ার বাসিন্দা সেল্টন সরদার পেশায় ভ্যানচালক। তিনি বলেন, ‘আগে সক্কালতি রাইত পইযন্ত গাড়ি চালাইনো যাইত। অ্যাকন গরমের ঠ্যালায় বেলা ১১টার পর আর রাস্তায় লাবা যাচ্চে না। মাজে মদ্দি রাস্তায় লাবলিউ প্যাছেন্দার পাওয়া যাচ্চে না।’

শুধু রিকশা বা ভ্যান না, দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ পথেও যাত্রী কমে গেছে অস্বাভাবিক হারে। রয়েল এক্সপ্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী এনামুল হক লোটাস এই প্রতিবেদককে জানান, তাপপ্রবাহ শুরুর পর থেকে চুয়াডাঙ্গা থেকে দূরপাল্লার সব পথে যাত্রী অস্বাভাবিকহারে কমে গেছে। কোনো কোনো দিন ট্রিপ মেরে খরচের টাকাও উঠছে না।

সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আতাউর রহমান মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির নীচে না নামা পর্যন্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। তাই এক-দুই ডিগ্রি তাপমাত্রা কমার পর যেনো অতি উৎসাহী হয়ে কেউ ইচ্ছে বাইরে চলাচল না করে। তাপপ্রবাহ চলাকালে স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলার পাশাপাশি প্রচুর পরিমান পানি পান এবং দুই বা তারও বেশিবার গোসল করতে হবে। শরীরকে শীতল রাখতে ভাজা-পোড়া খাবার ও চা-কফি পরিহার করতে হবে।’