চাকরি ছেড়ে মুরগির খামার, আকরামের মাসে আয় অর্ধলক্ষ টাকা

খামার থেকে ডিম সংগ্রহ শেষে হাতে নিয়ে যাচাই-বাছাই করছেন আকরাম। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার সিঙ্গিয়ায় ভাই ভাই অ্যাগ্রো মুরগি ফার্মেছবি: প্রথম আলো

একসময় অন্যের অধীনে চাকরি করতেন আকরাম। মাস শেষে নির্দিষ্ট বেতন মিলত ঠিকই, কিন্তু তাতে মনের খোরাক জুটত না। মনে হতো,  জীবনটা কি শুধু এভাবেই যাবে? কিছু একটা নিজের মতো করে গড়ে তুলতে হবে। এই ভাবনাই তাঁকে টেনে এনেছিল নিজের মাটিতে, নিজের গ্রামে। শুরু করেছিলেন ছোট্ট এক খামার দিয়ে। সেই খামারই এখন তাঁর সফলতার সবচেয়ে বড় ঠিকানা। খামার থেকে এখন তাঁর মাসে আয় প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা।

আকরাম মোল্যার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার হবখালী ইউনিয়নের সিঙ্গিয়া গ্রামে। বাবা আবদুর সামাদ মোল্যার চার সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁদের সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই ২০১৪ সালে এইচএসসিতে পড়ার সময়ই ভাগ্য বদলের আশায় চট্টগ্রামে পাড়ি দেন আকরাম। কাজ নেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। টানা তিন বছর চাকরি করে সিদ্ধান্ত নেন, আর নয় অন্যের হয়ে কাজ; এবার নিজের স্বপ্নের পথে হাঁটবেন।

২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন আকরাম। এ সময় পরিবার তাঁর পাশে দাঁড়ায়। তিন লাখ টাকা জোগাড় করে আকরাম শুরু করেন ‘ভাই ভাই অ্যাগ্রো ফার্ম’। শুরুতেই তোলেন দুই হাজার সোনালি জাতের মুরগির বাচ্চা। কিন্তু ভাগ্য তখন সহায় ছিল না। একে একে মারা যায় ১ হাজার ৬০০ বাচ্চা। একেবারে শুরুতেই এমন ধাক্কা অনেককেই হয়তো থামিয়ে দিত। তবে আকরাম হাল ছাড়েননি।

আকরাম বলেন, শুরুতেই এত বড় লোকসানে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন। কিন্তু ঠিক করেন—এখানেই থামবেন না। এরপর নতুন করে শুরু করলেন মিসরীয় ফাউমি মুরগির খামার, যাকে বলা হয় ‘ডিমের রাজা’। এই জাতটি রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী, ডিমও দেয় বেশি। ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করে বিক্রি শুরু করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

খামারের একটি শেডে রাখা হয়েছে বড় মুরগিগুলো। এই মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করে বিক্রি করেন আকরাম। সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার সিঙ্গিয়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

এ পর্যন্ত মুনাফা যা পেয়েছেন, তা থেকে সংসার চালিয়ে বাকিটা খামারেই আবার বিনিয়োগ করেছেন বলে জানান আকরাম মোল্যা। তিনি বলেন, আট বছরে একটি শেড থেকে এখন তাঁর খামারে ছয়টি শেড, আছে ডিম সংরক্ষণের ফ্রিজ, বাচ্চা ফোটানোর ইনকিউবেটরসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। বাচ্চা ও প্রাপ্তবয়স্ক মিলিয়ে খামারে এখন প্রায় চার হাজার মুরগি আছে। মুরগির পাশাপাশি গড়ে তুলছেন একটি গরুর খামার। আর যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিন লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে, সেই খামারের বর্তমান মূল্য এখন প্রায় ৪০ লাখ টাকা।

উদ্যোক্তা হয়ে আকরাম শুধু নিজেই স্বাবলম্বী হননি, তৈরি করেছেন কর্মসংস্থানের সুযোগও। সার্বক্ষণিক তাঁর খামারে কাজ করেন রমজান মোল্যা নামের এক যুবক। তিনি বলেন, ‘দেড় বছর যাবৎ এখানে কাজ করছি। যে বেতন পাই, তা দিয়ে সংসারডা চলে যায়। আমি ভালোই আছি এখানে কাজ করে।’

আকরামের খামারে থাকা এক মাস বয়সী এই বাচ্চার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

আকরাম জানান, মিসরীয় ফাউমি মূলত ডিম উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। ঠিকমতো যত্ন নিলে এই জাতের মুরগি সাড়ে চার মাস বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করে। একটানা প্রায় ১৫ মাস ডিম দেয়। বাজারে ডিমের দামও ভালো পাওয়া যায়। তবে ডিম বিক্রির চেয়ে বাচ্চা উৎপাদন করে বিক্রি করলে লাভ বেশি হয়। এর পরিচর্যাও তেমন কঠিন নয়। অন্যান্য মুরগির তুলনায় এদের রোগবালাই কম হয়। ফলে এটি পালনে লোকসানের ঝুঁকিও অনেকটা কম থাকে।

ডিম-বাচ্চা বিক্রিতেও নেই কোনো ভোগান্তি। অনলাইনে ভিডিও দেখে প্রতিনিয়ত দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসেন তাঁর বাড়িতে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী মুরগির ডিম-বাচ্চা সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। বেকার তরুণদের কাছে আকরাম যেন এখন এক অনুপ্রেরণার নাম। তাঁর দেখাদেখি আরও অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন এই মুরগি পালনে।

আকরামের উদ্যোগের প্রশংসা করে নড়াইল সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের ডিম এবং মাংসের চাহিদা পূরণে আকরামের খামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর উদ্যোগ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। আমরা তাঁর সফলতা কামনা করি। বেকার তরুণেরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এ রকম খামার করলে তাঁদের বেকারত্ব ঘুচবে।’